আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের বেশির ভাগেরই সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। নিজেদের পাশাপাশি কয়েক বছরের ব্যবধানে স্ত্রীর সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অঢেল ধনসম্পদের পাশাপাশি সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদারের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করা প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী থেকে এসব তথ্য মিলেছে। সম্পদ বিবরণীতে এক এমপির স্ত্রী ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার উপহার হিসেবে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধিরা আগের বছরের সঙ্গে এবারের সম্পদ বিবরণী তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পেয়েছেন।
পটুয়াখালী : তিনবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার মনোনয়ন না পেয়ে পটুয়াখালী-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের ১৫ বছরে আয় বেড়েছে ২৯ গুণ। তার স্ত্রীর বার্ষিক আয় না থাকলেও এই সময়ে ২২ গুণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রেড়েছে। ২০০৮ সালের আগে তার নামে কোনো মামলা না থাকলেও প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর দুদকের দায়ের করা একাধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জানা যায়, ২০০৮ সালে মাহবুবুর রহমানের বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার যা বর্তমানে হয়েছে ৬০ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯২ টাকা। ২০০৮ সালে কৃষি, বাড়ি বা দোকানভাড়া ও অন্য কোনো ব্যবসা খাত থেকে আয় না থাকলেও বর্তমানে কয়েক লাখ টাকা আয় দেখানো হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের হলফনামায় ব্যাংকে জমা ছিল ৮৩ হাজার ১১২ টাকা, ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি গাড়ি, ২০ তোলা স্বর্ণালংকার এবং ইলেকট্রনিক মালামাল ও আসবাবপত্র। সব মিলিয়ে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার ১১২ টাকা। পাশাপাশি তার স্ত্রী ছিল মাত্র ৫ লাখ টাকা। যা ১৫ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭৯ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে গাড়ি, স্বর্ণ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং আসবাবপত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র। মাহবুব তালুকদারের স্ত্রীর ব্যাংকে জমা টাকা, কোম্পানির শেয়ার, স্থায়ী আমানত, গাড়ি, স্বর্ণালংকার ও আসবাবপত্রসহ রয়েছে ৯০ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৩ টাকার। বর্তমানে ২৬.১৭ একর কৃষিজমি, অকৃষি জমি ৬ কাঠা ১৩ ছটাক, আট তলা ভবন এবং মৎস্য খামারসহ ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫১ টাকার স্থাবর সম্পত্তির হিসাব উল্লেখ করেছেন। স্ত্রীর নামে রয়েছে ০ দশমিক ০৭৮৪ এক অকৃষি জমি। যার মূল্য ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর বর্তমানে ব্যাংক ঋণ রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৯২৯ টাকা। কিন্তু ২০০৮ সালে গাড়ির অনুকূলে ব্যাংক ঋণ ছিল মাত্র ৩ লাখ ২০ হাজার ২৫২ টাকা। ১৫ বছর আগে তার স্ত্রীর ছিল না কোনো স্থাবর সম্পদ। স্ত্রীর কোনো বার্ষিক আয় না থাকলেও ১৫ বছরে অস্থাবর ১৮ ও স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু, রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, আফজাল হোসেন ও নাজমুল হাসান পাপনের সম্পদ বিগত পাঁচ বছরে অস্বাভাবিক বেড়েছে। তৌফিক ছাড়া অস্বাভাবিক নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে তিনজনেরই।
কিশোরগঞ্জ-৩ : (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নুর ২০১৮ সালে নগদ টাকা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ৯২ হাজার। বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৪১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৩ টাকা। এ ছাড়া স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ হয়েছে ৭ কোটি ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৮২৫ টাকার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সম্পত্তি ছিল ৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৩৭১ টাকার। তার বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে ২৩ হাজার ৭০৫ ডলার। হলফনামায় ৫৮ তোলা স্বর্ণ থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও এর মূল্য জানা নেই বলে লিখেছেন। স্ত্রীর সম্পদ ১ কোটি ৭৬ লাখ ১৫ হাজার ৪২২ টাকা। স্ত্রীর শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানতে আয় ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৬০৪ টাকা, নগদ ও ব্যাংকে জমা ১১ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৪ টাকা। সঞ্চয়পত্রে স্থায়ী আমানত ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বৈদেশিক মুদ্রা ২২ হাজার ৭২৮ ডলার এবং ২৯ ভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ-৪ : (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) বর্তমান সংসদ সদস্য সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জ্যেষ্ঠপুত্র রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের পাঁচ বছর আগে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ১ হাজার ৯৭ টাকা। এবার তা কমে হয়েছে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৭০ টাকা। তার বর্তমান স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ১১ কোটি ৩২ লাখ ৬ হাজার ৯০৭ টাকা। ২০১৮ নির্বাচনে তার সম্পত্তি ছিল ৭ কোটি ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার ৬১৯ টাকা। বিগত পাঁচ বছরে তার আয় বেড়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ২৮৮ টাকা।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা অর্থের পরিমাণ ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা এবং ব্যাংক সুদ বাবদ তার বার্ষিক আয় ১১ লাখ ২৪ হাজার ৮৮৩ টাকা। বন্ড, ঋণপত্র স্টক এক্সচেঞ্জে তার শেয়ার ২৮ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে আরও ৫ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্রে স্থায়ী আমানত রয়েছে ১৫ লাখ টাকা ছাড়াও ১০ ভরি স্বর্ণালংকারের মূল্য দেখানো হয়েছে ২০ হাজার টাকা। তৌফিকের স্ত্রীর নামে বর্তমানে রয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ ১৫ হাজার ৪২২ টাকা। এ ছাড়া উপহার হিসেবে পাওয়া ১০০ ভরি স্বর্ণালংকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ-৫ : (বাজিতপুর-নিকলী) বর্তমান সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের গত পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়েছে ৯ কোটি ১০ লাখ ২২ হাজার ৮৬ টাকার। হলফনামা অনুযায়ী তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৩ কোটি ২ লাখ ৭০ হাজার ৯৩৭ টাকা। ২০১৮ সালে তার সম্পদ ছিল ২৩ কোটি ৯২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৫১ টাকা। এবার তার নগদ টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার ৬১১ টাকা। ২০১৮ নির্বাচনে নগদ টাকা ছিল ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮৬ হাজার ৭০৫ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এবার তার জমা টাকার পরিমাণ ৬২ লাখ ২৭৩, যা পাঁচ বছর আগে ছিল ৫০ লাখ ২ হাজার ৭৫১ টাকা। তার স্ত্রীর সম্পত্তির দেখানো হয়েছে ৮ কোটি ৩৬ হাজার ৯৮৮ টাকা। ২০১৮ তে ছিল ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫ হাজার ১২৯ টাকা।
কিশোরগঞ্জ-৬ : (ভৈরব-কুলিয়ারচর) বর্তমান সংসদ সদস্য বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনের ৫ বছর আগে নগদ টাকা ছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার ৪৪১ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪৬ টাকা। দ্বাদশ নির্বাচনে হলফনামা অনুযায়ী তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৫৩ কোটি ৬৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৮ টাকার। ২০১৮ নির্বাচনে মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭৪৯ টাকা। হলফনামা অনুযায়ী বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান থেকে ভাড়া বাবদ বাৎসরিক আয় ২১ লাখ ৩০ হাজার ২৭৫ টাকা। সঞ্চয়পত্র রয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকার। ব্যাংকে আমানত ৬৮ লাখ ৮০ হাজার ১৫৪ টাকা। জীবনবীমা রয়েছে ৯৬ লাখ ৩ হাজার ২৩ টাকার। এ ছাড়া উপহার হিসেবে পাওয়া ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। স্ত্রীর নামে নগদ রয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ২০০ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯০ হাজার ২৭৭ টাকা। সেভিংস সার্টিফিকেট ১ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রে স্থায়ী আমানত রয়েছে ৮ কোটি ৭৬ লাখ ৬ হাজার ৫৩৩ টাকা। স্ত্রীর নামেও দেখানো হয়েছে উপহার হিসেবে পাওয়া ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার।
ফেনী : ফেনী-৩ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের চেয়ে স্ত্রীর সম্পদ বেশি। তবে স্ত্রীর চেয়ে তার নিজের বেশি স্বর্ণ রয়েছে। নিজের নামে ৯৫ ভরি ও স্ত্রীর নামে ৫০ ভরি স্বর্ণ আছে। স্ত্রীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ৯ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৪৭১ এবং তার সম্পদ ৮ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার ২৯৯ টাকা। মাসুদ চৌধুরীর হাতে নগদ টাকা রয়েছে ১০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ও ৪ হাজার ৭১১ ইউএস ডলার। এ ছাড়া স্ত্রীর নগদ রয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়াও নিজের ও স্ত্রীর বিভিন্ন কোম্পানির কয়েক লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে।
বরগুনা : বরগুনা-১ আসনে অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপির গত ৫ বছরে সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। বার্ষিক আয় বেড়েছে ১০ লাখের ওপরে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে হলফনামায় স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ দেখানো হয়নি। এবারে স্ত্রীর স্থাবর, অস্থাবর এবং নগদ টাকাসহ সম্পদ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ২ হাজার ৩৫২ টাকা। আসন্ন নির্বাচনে আইন পেশা, ব্যাংক সুদ ও এমপি সম্মানী থেকে বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ৫৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৩১ টাকা। ২০১৮ সালে মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৯২ লাখ ৬১ হাজার ১৯০ টাকা। এবার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার ৭২৫ টাকা দেখানো হয়েছে।
ফরিদপুর : ফরিদপুর-১ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন শাহ্ মোহাম্মাদ আবু জাফর। তিনি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। নিজ নামে দালান, আবাসিক ও বাণিজ্যিক বিবরণীতে উত্তরা মডেল টাউনে জমি ৫ কাঠা লেখা হলেও মূল্য লেখা হয়নি। এ ছাড়া নিজ নামে চারটি ফ্ল্যাট থাকলেও সেখানে লেখা হয়েছে মূল্য অজানা। বার্ষিক আয় কৃষি খাত থেকে ২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ভাড়া বা অন্যান্য ভাড়া ২ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে ২ লাখ টাকার স্বর্ণ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, নিজের নামে ২৫ হাজার টাকা ও স্ত্রীর নামে ৫৫ হাজার টাকা রয়েছে।