কূটনীতিকদের চোখ রাজনীতি অর্থনীতিতে

ভোট-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতির নানা মেরূকরণ এবং সমস্যাসংকুল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তবে তা আগের মতো সরব বা স্বশব্দে নয় বরং অনেকটা নীরবেই চলছে বিদেশি বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগীদের নিবিড় ওই পর্যবেক্ষণ। পেশাদার কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি এবং তার মিত্রদের দাবিকে ‘অগ্রাহ্য’ করে নির্বাচন কমিশনের তড়িঘড়ি তফসিল ঘোষণায় ভোটে বিদেশিদের আগ্রহ এমনিতেই কমে গেছে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ নির্বাচনের আমেজ তৈরির বদলে ডামি প্রার্থী রাখা এবং নিজেদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে ওই নির্বাচনের ফল কী হবে তা অন্তত বিদেশিদের অনুমানের বাইরে থাকার কথা নয়। ফলে সঙ্গত কারণেই ভোটে চোখ নয় বরং ভোট-পূর্ব রাজনীতিতে আর কতো চমক আসছে- তা দেখতেই আগ্রহী কূটনীতিকরা।

পূর্বের এক বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা  বলেন, এক আড্ডায় বিদেশি ওই কূটনীতিক প্রশ্ন রেখেছেন- সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গেই যদি ক্ষমতাসীনদের আসন ভাগাভাগি হয় তাহলে ভোটটা কোথায়, কীভাবে হবে? ওই কর্মকর্তা বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তথা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট নিশ্চিত করতে প্রকাশ্যে এবং পর্দার অন্তরালে দূতিয়ালিতে সক্রিয় ছিলেন কাছের এবং দূরের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা। কিন্তু সরকারি দল এবং বিরোধী পক্ষের নানা শর্তে তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এ জন্য শেষ সময়ে এসে ‘শর্তহীন’ সংলাপের অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা-ও হালে পানি পায়নি। ন্যূনতম সমঝোতারও সুযোগটুকু রাখেনি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা পক্ষগুলো। এটাকে ভোটে কূটনীতিকদের আগ্রহ হারানোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা কূটনীতিকদের রহস্যজনক নীরবতার সাম্প্রতিক দুু’টি ঘটনার উদাহরণ টানেন।

তার দাবি কার্যত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকেই ভোট নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে।

২৮শে অক্টোবরকে বাংলাদেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই দিন বর্তমান সরকারের আমলে নিবন্ধন হারানো জামায়াত শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সরকারের সামনে থাকা ভোটের মাঠের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি’র পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সমাপ্তি ঘটেছে রক্তাক্ত সংঘর্ষের মধ্যদিয়ে। এ ঘটনার বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবহিত করতে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক জমায়েত আয়োজন হয়েছিল ঢাকায়। নজিরবিহীন ওই জমায়েতে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে পুলিশ কমিশনারও উপস্থিত ছিলেন। ওই ব্রিফিংয়ে ২৮শে অক্টোবরের ঘটনার জন্য একতরফাভাবে বিরোধীদের দায়ী করা হয়। ব্রিফিংয়ে পূর্ব, পশ্চিম, কাছের এবং দূরের সব রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর শতভাগ প্রতিনিধিত্ব ছিল। নাতিদীর্ঘ তবে বড় ওই জমায়েতে সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে একটি কথাও বলেননি উপস্থিত প্রতিনিধিরা।

তাদের এই ‘আচমকা নীরবতা’ বা চুপ থাকাই ছিল সেদিন এবং পরবর্তীতে গণমাধ্যমের মুখ্য আলোচ্য। দ্বিতীয় উদাহরণ টেনে ওই কর্মকর্তা বলেন, শুধু ঢাকা নয়, নভেম্বরে নয়াদিল্লিতেও অনুরূপ একটি কূটনৈতিক ব্রিফিং হয়। বাংলাদেশে দূতাবাস নেই, কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন ৯০টি দেশের প্রতিনিধি যারা বাংলাদেশ দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা আমন্ত্রিত ছিলেন সেই ব্রিফিংয়ে। তফসিল ঘোষণার পরের সপ্তাহে অনুষ্ঠিত নয়াদিল্লির ওই ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রস্তুতি এবং অন্যান্য বিষয় ৯০ দেশের কূটনীতিকদের সামনে সবিস্তারে তুলে ধরেন সে সময় ভারত সফরকারী পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি তাদের বাংলাদেশের ৭ই জানুয়ারির ভোট পর্যবেক্ষণেরও আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু, দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ৯০ দেশের প্রতিনিধির একজনও পররাষ্ট্র সচিবের নির্বাচন বিষয়ক বক্তব্যের প্রতি-উত্তরে অর্থাৎ প্রশ্নোত্তর সেশনে কোনো কথা বলেননি। বরং কনকারেন্ট অ্যাম্বাসেডরদের মধ্যে যারা এখনো এগ্রিমো বা ক্রিডেনশিয়াল সাবমিশনের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা কতো দিনে বাংলাদেশে এসে পরিচয়পত্র পেশ করতে পারবেন- তা নিয়েই ছিল অনেকের জিজ্ঞাসা। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দিল্লিস্থ বাংলাদেশের অনাবাসী দূতরা অনেকটা উদাসীন বা আগ্রহী নয় বলে দাবি করেন সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা।

Exit mobile version