দেশের দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির এ ব্যর্থতায় ক্রমেই দেশে দুর্নীতি বেড়ে চলছে। একই সঙ্গে বাড়ছে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা। বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হলেও জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। দুদক কর্মকর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটররা মনে করছেন, তথ্য-প্রমাণের অভাব ও ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকায় অনেককেই শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না বলেই দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি কমছে না।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা এসব অর্থ পাচার করে থাকেন। যারা অর্থ পাচার করেন, তাদের চিহ্নিত করা গেলেও এর প্রমাণ পেতে তিন-চার বছর কেটে যায়। আবার সবগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করলেও তার সুফল মিলছে না।
এমন প্রেক্ষাপটে ‘উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশ জুড়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে এবার জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন (আনকাক) বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দুদকও দেশে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক বছরে ছয় হাজারের বেশি অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করলেও বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্তের সংখ্যা হাতেগোনা। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির রাঘববোয়ালরা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংস্থাটি সরকারের বিভিন্ন পদে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ও দুর্নীতিবাজদের ধরতে সাহসও পায় না। যেমন আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে যে প্রার্থী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে হলফনামা দিয়েছেন, তাদের অনেকের অস্বাভাবিকভাবে সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। যাদের আয় থেকে সম্পদ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে।
যদিও বিদেশে অর্থ পাচার রোধ, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আর পাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে একযোগে কাজ করছে রাষ্ট্রের আটটি সংস্থা। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না অর্থ পাচার। ফেরত আনা যাচ্ছে না বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী অ্যাভিডেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলে সময় লেগে যাচ্ছে তিন-চার বছর। আর সব অ্যাভিডেন্স না পাওয়ায় দুর্নীতিবাজদের সাজা হচ্ছে না।
দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখার একজন উপপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দেশের বেশি টাকা পাচার হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। যারা দুর্নীতিবাজ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেন তার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখা বা অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া যায়। কিন্তু এসব অর্থ পাচারের ঘটনা অনুসন্ধান-তদন্ত করে বিচারের জন্য আদালতে পাঠাতে হলে অ্যাভিডেন্স দরকার। সেই অ্যাভিডেন্সের জন্য দুদক থেকে সংশ্লিষ্ট দেশে মিচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকুয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠাতে হয়। এটি দুদক থেকে পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পরে এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার পাঠায় তাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরে। এভাবে অ্যাভিডেন্স পেতে তিন-চার বছর লেগে যায়।
তিনি বলেন, ৮ থেকে ১০টি দেশে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে দুয়েকটি দেশ থেকে অ্যাভিডেন্স পাওয়া গেলেও অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া যায়নি। যে দেশগুলোতে বাংলাদেশের অর্থ যাচ্ছে সে দেশের আইনকানুন মেনে অ্যাভিডেন্স পাঠানো হয় বিধায় সব প্রমাণ পাওয়া যায় না। অ্যাভিডেন্স পেতে বিলম্ব ও সব ঘটনার অ্যাভিডেন্স না পাওয়ায় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
দুদকের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘টাকা পাচারের মাধ্যমে পুরো দেশকে আর্থিকভাবে অচল করে দেওয়া হচ্ছে, পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। টাকা পাচারের ওপর আমরা যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি, আন্তর্জাতিকভাবে যেন এমনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণ চেয়ে বিভিন্ন দেশে যেসব চিঠি পাঠাই সেগুলোর বিষয়ে যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাহলে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা যাবে। যারা টাকা পাচার করছে তাদের কয়েকজনকে যদি উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে সবাই টাকা পাচার করতে ভয় পাবে।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য, বড় ব্যাংকার থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের কারণে এ অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। কাগজে কলমে ব্যাংক খাত এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি আছে। কিন্তু সেই নজরদারি যথেষ্টভাবে সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করছে না।’
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৯২৭টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়। ২০২২ সালে আগের চলমান অনুসন্ধানসহ ৪ হাজার ৬৩৩টি অভিযোগের অনুসন্ধান এবং ২ হাজার ১৩টি মামলার তদন্ত চলমান ছিল। সব মিলিয়ে ২০২২ সালে ৬ হাজার ৬৪৬টি অনুসন্ধান ও তদন্তের মধ্যে বড় দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত দেখা যায়নি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি ও হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচার মনিটরিং সংস্থা-বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) প্রতিবেদনেও এমনটাই বলা হয়েছে।
তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থ পাচারসংক্রান্ত সাড়ে তিন হাজারের মতো প্রতিবেদন জমা রয়েছে, যা নিয়ে কাজ করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচটি সংস্থা। এসব সংস্থার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) রয়েছে।
দিবসের কর্মসূচি : দিবসটি নিয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুর্নীতি শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা। সমাজের উন্নয়নের সবক্ষেত্রকে দুর্বল করে। এটি আইনের শাসনকে বিঘ্নিত করে, দারিদ্র্য উসকে দেয়, সম্পদের অবৈধ ব্যবহার সহজতর করে এবং সশস্ত্র সংঘাতের জন্য অর্থায়ন করে শান্তি প্রক্রিয়া প্রক্রিয়া বিনষ্ট করে। দুর্নীতি দূর করতে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে আনকাক কাজ করছে। এ সংস্থার আহ্বানে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশও সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে দিবসটি পালন করবে।
দুদক সচিব জানান, বাংলাদেশে ২০১৭ সাল থেকে দিবসটি পালিত হলেও এবারই প্রথম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দিবসটির মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এবারের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপসমূহে দুর্নীতিবিরোধী বাণী সংবলিত ব্যানার স্থাপন। দুদকের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে সকাল ৮টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কমিশনাররা জাতীয় পতাকা ও দুদক পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি। এ ছাড়া সারা দেশে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দৃশ্যমান স্থানে দুর্নীতিবিরোধী বাণী সংবলিত ব্যানার স্থাপন, জাতীয় পতাকা ও দুদক পতাকা উত্তোলন, ফেস্টুন-বেলুন ওড়ানো, মানববন্ধন, আলোচনা সভা এবং দুর্নীতিবিরোধী তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে।