আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ছকে ভীতির সৃষ্টি করেছে ১৪ দলীয় জোটের শরিক ও সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) ভেতরে। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মতোই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমন্বয় করে তথা ভাগাভাগি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চায় ১৪ দলীয় জোট ও জাপা। তবে আওয়ামী লীগ সব আসনে উন্মুক্ত করে ভিন্ন পথে হাঁটতে চায়।
তৃণমূল বিএনপি, কল্যাণ পার্টি, বিএনএমসহ অন্য যেসব দল নির্বাচনে এসেছে সেগুলোর কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ছাড় দেওয়া হতে পারে। কিন্তু তাদেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসার কথা বলা হচ্ছে। তবে শেষপর্যন্ত তাদেরও ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মতো ছাড় দেওয়া হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান। অবশ্য শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে সব মিলিয়ে যত আসন সমন্বয় করা হবে, সেটা স্বতন্ত্রের আসনের বেশি হবে না।
সর্বশেষ জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ চার-পাঁচজন নেতাকে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে সবুজ সংকেত দিলেও অন্য নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে হতে পারে। জোটের সব প্রার্থীর দায়িত্ব নেওয়া হবে না বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘জোটগতভাবে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টা চূড়ান্ত হয়েছে। আসন বণ্টনের বিষয়টি আমির হোসেন আমু আর ওবায়দুল কাদের বসে ঠিক করবেন।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, গত তিনটি সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আলাদা। ফলে এবারের নির্বাচন জমানোই হলো আওয়ামী লীগের অন্যতম লক্ষ্য। উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করা ও ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করার বিষয়ে বেশি সচেষ্ট ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই আসন্ন নির্বাচনে নিজের শক্তিতে জিতে আসার ছক ধরেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ। এ ছকে এবারের নির্বাচন উন্মুক্ত রাখাই হলো দলটির কৌশল।
১৪ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জোট নেতারা জোটগতভাবে ভোট করতে একাট্টা। আগের নির্বাচনগুলোর মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও জোটগতভাবে করতে চান তারা। শুধু জোটই নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্বাচন করতে চায় বিরোধী দল জাপাও।
সোমবার রাতের বৈঠকে ১৪ দলীয় জোট নেতাদের চাওয়া প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি চান এবার নির্বাচন উন্মুক্ত হবে। ফলে জোটের শরিক নেতাদের মধ্যে জয়-পরাজয় নিয়ে শঙ্কা ঝেঁকে বসেছে। এ ছাড়া ভোটে আসা অন্য দলগুলোর মধ্যেও ভয় আছে। অবশ্য জোটের আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন। এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, দুয়েক দিনের মধ্যে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেন, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো না এলেও নিবন্ধিত অনেক দলকে নির্বাচনে আনতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। ভোট জমাতে ও উৎসবমুখর করতেই তা করা হয়েছে। ২৮টি দল নির্বাচনে এলেও তারা মনে করছেন, নির্বাচন উৎসবমুখর করা ও ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে এ দলগুলো যথেষ্ট নয়। কারণ আওয়ামী লীগ বাদ দিলে ভোটে আসা দলগুলোর জনসমর্থন ও কর্মিবাহিনীর অভাব আছে।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, এজন্য আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটে নামায় এ পর্যন্ত নির্বাচনী কার্যক্রম জমজমাট করা সম্ভব হয়েছে। জোট ও জাপার সঙ্গে আসন সমন্বয় করে নির্বাচন হলে ভোটের উৎসবে ভাটা পড়বে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এমন ভাবনার সঙ্গে একমত হতে পারছেন না জোটের শরিক ও জাপার নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, আসন সমঝোতা ও সমন্বয় না হলে অনেক কিছুই আটকে যেতে পারে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৮ ডিসেম্বরের পর বোঝা যাবে নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু আছে কি না। এ বিষয়ে জাপার ওই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন, বক্তব্যটি ইঙ্গিতপূর্ণ।’
জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যায় জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। জাপার আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মাশরুর মাওলা বিষয়টি নিশ্চিত করলেও চুন্নু বলেন, ‘আমাদের গণভবনে যাওয়ার তথ্য সঠিক নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ বুধবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমুর সঙ্গে আমাদের বৈঠক আছে।’
আসন সমন্বয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দুই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও এক সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য বলেন, আসন সমন্বয়ের ব্যাপারটি দলীয় সভাপতি এখনো গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন না। তবে বর্তমান সংসদে জোটের যেসব নেতা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা থাকুক অন্তত সেটা চান। শরিকদের এমন চাওয়ায় ছোট দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের জিতিয়ে আনার এক ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে জানান তারা। জোটের বাইরে ভোটে আসা অন্য দলগুলোর পরিচিত ও শীর্ষ নেতাদের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। জাতীয় পার্টির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনা এখনো অপরিবর্তিত বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি চান, লড়াই করে জিতুক জাপা মনোনীত সংসদ সদস্যরা।
সূত্র জানায়, জাপার তিন নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তিনি তাদেরও উন্মুক্ত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দেন। তবে এ পর্যায়ে প্রস্তুতি নিতে গেলে জাপার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বলে দলটির নেতারা শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন। জানা গেছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরও দুয়েক দিন সময় নেওয়া হতে পারে। জাপার আরেক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টি আসন সমঝোতা না করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঝুঁকি কোনোভাবেই নিতে চাচ্ছে না।
এদিকে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ নেতারাও নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে গতকাল বৈঠক করেছেন। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর বাসায়ও বৈঠকে বসেন। জানা গেছে, অন্তত কিছু আসনে ছাড় বা সমঝোতার প্রস্তাব আওয়ামী লীগ প্রধানের কাছে তুলে ধরার বিষয়টি জোটের শীর্ষ নেতারা আমুকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘নির্বাচনে জোটগতভাবে এবং নৌকা প্রতীকে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে আসন বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত কিছু জানানো হয়নি। আসনের বিষয়টা নিয়ে আমু ভাই কথা বলে ঠিক করবেন।’
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ১৪ দলের গুরুত্বটা বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। জোটের দরকার আছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আদর্শিক এ জোটকে এগিয়ে নিতে হবে, সেটাও বলেছেন তিনি।