বার্ধক্যই তাকে রাজনীতির ময়দান থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে

গোধূলিলগ্ন, পরিচ্ছন্ন ঘরের পর্দা বাতাসে দুলছে। পর্দার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে অস্তমান সূর্য। ঘরের এক কোণে রাখা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে গিটার বাজাচ্ছেন এক প্রবীণ। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে মার্কিন পপশিল্পী জিম রিভসের গান ‘ইউ আর দ্য অনলি গুড থিং’। গিটারে তার সঙ্গে যিনি সুর মেলাচ্ছেন তিনি আর কেউ নন অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

গত ১১ অক্টোবর ছিল তার ৯৩তম জন্মদিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন তথ্যই দেখা গেছে। একসময় রাজনীতি ও চিকিৎসা পেশায় দম ফেলার ফুসরত ছিল না যার, তিনি এখন ঘরবন্দি; অখণ্ড অবকাশ তার। একজন সাধারণ মানুষ থেকে হয়েছিলেন বাংলাদেশের ১৫তম রাষ্ট্রপতি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্ণাঢ্য জীবন তার। ইতিহাসের বহু ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী; এখন বার্ধক্যের কাছে হার মেনেছেন। দেশের রাজনীতির পরতে পরতে পদচিহ্ন রাখা প্রবীণ এই রাজনীতিক রাজনীতি থেকে এখন যোজন যোজন দূরে। এবার তার একমাত্র ছেলে মাহী বি. চৌধুরীরও মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে; কেসি (কফিল উদ্দিন চৌধুরী) পরিবার কি রাজনীতির ময়দান থেকেই ছিটকে পড়ল!

রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল বাবা অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরীকে দেখে। কৃষক প্রজা পার্টির সহসভাপতি, যুক্তফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন কফিল উদ্দিন। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার মজিদপুর দয়হাটা গ্রামের বাড়িতে রাজনৈতিক আবহ থাকত সারাক্ষণ। সে আবহেই বেড়ে ওঠা বি. চৌধুরীর। ১৯৪৭ সালে ঢাকার বিখ্যাত স্কুল সেন্ট গ্রেগরি থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ১৯৫৪-৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস লন্ডন, এডিনবার্গ ও গ্লাসগো থেকে এফআরসিপি ও বাংলাদেশের (সম্মানিত) এফসিপিএস তিনি।

১৯৩০ সালের ১১ অক্টোবর কুমিল্লা শহরে (প্রখ্যাত মুন্সেফ বাড়ি) নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিক ছিলেন হৃদরোগের চিকিৎসক। বারিধারায় গড়ে তুলেছিলেন কেসি মেমোরিয়াল হাসপাতাল। সেখানেও এখন তার পদচিহ্ন পড়ে না। কদাচিৎ সেখানে গেলেও আগের মতো রোগীদের চিকিৎসা-সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়া হয় না। জীবনের ৯৩ বসন্ত পেরোনো এই ‘তরুণ’ বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবের পর নিজের গণ্ডি একেবারে ছোট করে আনেন। দিন, সপ্তাহ বা মাসের বেশিরভাগ সময় তার কাটে বারিধারার বাসভবন ‘মায়া-বি’তে।

তার একমাত্র ছেলে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরী জানান, ‘বারিধারার বাসভবনেই এখন অবসরজীবন কাটাচ্ছেন তার বাবা। বাড়ি থেকে খুব একটা বের হন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও একেবারে সীমিত। জরুরি প্রয়োজনে হয়তো যোগ দেন। মূলত বার্ধক্যের কারণে তিনি নিজের মতো সময় কাটান।’

তিনি বলেন, ‘বার্ধক্য ছাড়া বড় ধরনের কোনো রোগ নেই। বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হেসে-খেলে, বাগান করে, গিটার বাজিয়ে, নিজের পছন্দের কাজের মাধ্যমে সময় কাটান। সময়টাকে উপভোগ করেন তিনি।’

বি. চৌধুরীর ব্যক্তিগত সহকারী মো. ওবায়দুল হক জানান, ‘করোনার পর বারিধারার কেসি মেমোরিয়াল হাসপাতালে আর বসেননি তিনি। তবে মাঝেমধ্যে সেখানে যান।’

তার ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, মায়া-বি’তে তার মেয়েদের সন্তানরা নিয়মিত আসে। ছেলের পক্ষের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। তারাও মাঝে মাঝে আসে। বি. চৌধুরীর পাঁচ বোন ও তিন ভাই। গুলশান ও নিকেতনে থাকা বোনের বাসায় প্রায়ই বেড়াতে যান তিনি।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুরোধে ১৯৭৮ সালে রাজনীতি শুরু করেন। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে ১৯৭৯ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, মন্ত্রিসভায়ও স্থান হয় তার। ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হয়ে প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী ও পরে সংসদ উপনেতা হন। ১৯৯৬ সালে বিরোধীদলীয় উপনেতা, ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সে বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং ২০০১ সালেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাকালীন মহাসচিব।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেই বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, যাতে ‘নিরপেক্ষ’ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় শুরু থেকেই সমস্যার আভাস মিলছিল। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু নেপালে সার্ক কনফারেন্স থেকে ফিরে খালেদা জিয়া তাকে অবহিত করেননি। অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রীদের বৈঠক থেকে ফিরেও দেখা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে সরকারের একটি মহল থেকে আপত্তি উঠলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। বড় ধাক্কাটা আসে প্রধানমন্ত্রী যখন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বি. চৌধুরী খালেদা জিয়াকে ফুল ও শুভেচ্ছা বাণী পাঠিয়ে, ফোন করে কুশলবিনিময় করলেও খবর রটে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কোনো খোঁজখবর নেননি। খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর বিএনপির পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে কনিষ্ঠ এমপিদের কয়েকজন তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন। পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।

পরে তিনি বিকল্পধারা নামের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বিএনপিতে ভাঙন ধরানোই কি বিকল্পধারার উদ্দেশ্য! এমন এক প্রশ্নের জবাবে তখন সাংবাদিকদের বি. চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বর্তমান বিএনপি জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে সরে গেছে। জিয়াউর রহমানের মূল কথায় বিএনপি আর নেই। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন আর দেশপ্রেমের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত। তাই বিকল্পধারা নামের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন।’ বিএনপি নেতারা তখন বলেছিলেন, ‘অতিমাত্রায় নিরপেক্ষ সাজতে চেয়ে, জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত না করে তিনি বিএনপির মনঃক্ষুণ্নতার কারণ হয়েছেন। বিভিন্ন সেমিনারের বক্তব্যে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উল্লেখ না করাটাই তার কাল হয়েছে।’

২০০৪ সালের ৮ মে বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের পর ২০১৭ সালে নিজে আহ্বায়ক হয়ে নতুন বিকল্প রাজনৈতিক জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেন তিনি। এতে বিকল্পধারা বাংলাদেশ ছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য ছিল। সে জোট টেকাতে পারেননি তিনি। ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাজোটের অংশ হয়ে জাতীয় নির্বাচনে তার দল অংশ নেয়। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে। এখনো মহাজোটের অংশ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে বিকল্পধারা বাংলাদেশ।

দলের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের পদ থাকলেও বি. চৌধুরী এখন আর সক্রিয় কর্মকাণ্ডে দৃশ্যমান হন না। সহধর্মিণী হাসিনা ওয়ার্দা চৌধুরী, বড় মেয়ে ব্যারিস্টার মুনা চৌধুরী, ঢাকার উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনারত চিকিৎসক ছোট মেয়ে শায়লা চৌধুরী আর একমাত্র ছেলে মাহী বি. চৌধুরীর সঙ্গেই সময় কাটান তিনি।

এবার জামিনদার হিসেবে ঋণখেলাপির কারণে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে মাহী বি. চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। মাহী চৌধুরী এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারার ভাইস চেয়ারম্যান।

রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে শ্রদ্ধেয় হলে বিতর্কও রয়েছে তাকে নিয়ে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বদরুদ্দোজা চৌধুরী জড়িত বলে বিরোধীপক্ষের অভিযোগ। তাদের বক্তব্য, ‘জিয়া হত্যার সময় পাশের কক্ষে থাকলেও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দরজায় টোকাও পড়েনি। অথচ জিয়া ঝাঁজরা হয়ে গেলেন।’ সরকারের শীর্ষপর্যায়ে থেকেও নিজ এলাকার খুব একটা উন্নয়ন করতে পারেননি বলেও সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের হতাশা রয়েছে।

Exit mobile version