চলতি বছরের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আদলেই জাতীয় নির্বাচনের নকশা সাজিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃত্বাধীন সরকারের এ মেয়াদে নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্কের মধ্যেও গাজীপুর নির্বাচন উৎসবমুখর হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও সন্তোষজনক। বিএনপি এ সমমনা দলগুলো অংশ না নিলেও গাজীপুরের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে এক ধরনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। এ কারণেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর ডিজাইন অনুসরণ করতে চায় আওয়ামী লীগ।
দলটির নেতারাও বলছেন, গাজীপুর মডেলে নির্বাচন করার মূল লক্ষ্য তিনটি। প্রথমত ভোটের মাঠে উৎসব, দ্বিতীয়ত কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ঘটানো এবং তৃতীয়ত নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা। তারা মনে করছেন, তাদের এ লক্ষ্য পূরণ করবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার কৌশল।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপিকে বাইরে রেখে আর যাই হোক, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। তাছাড়া গাজীপুরের নির্বাচন ছিল স্থানীয় সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন। সেটার সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের মিল খোঁজা অবান্তর।
গত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। সেদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ২৯৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। অন্যদিকে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা চার শতাধিক।
এ অবস্থায় ভোটের মাঠে সংঘাতের আশঙ্কার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে গতকাল শুক্রবার প্রশ্ন করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ঢালাওভাবে নির্বাচন করতে পারবেন না।
দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগের দিন গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে, যা প্রয়োগ করা শুরু করেছে জুলাই মাসে। দেশটির নতুন শ্রমনীতিও বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ তৈরি করেছে। এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম অধিকার নীতিতে বাণিজ্য জরিমানা ও ভিসা বিধিনিষেধের শিকার হতে পারে বাংলাদেশ।
চাপ উপেক্ষা করেই আওয়ামী লীগ সরকার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনও ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করেছে। এর দুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র শর্তহীন সংলাপ করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনড় অবস্থানের কারণে তা হয়নি।
সরকারের পদত্যাগ এ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে ফেলার পর বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার কৌশল নিয়েছে। এখন তারা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে যতগুলো সম্ভব নিবন্ধিত দলকে নির্বাচনে আনতে চায়। এ ছাড়া ভোট উৎসবমুখর করতে নিজেদের মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বলছে।
আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন এক না হলেও গাজীপুরের ভোটে যেভাবে ভোটার উপস্থিতি ঘটেছে, তা অভূতপূর্ব বলে মনে করেন তিনি। এমনটা জাতীয় নির্বাচনে ঘটুক আওয়ামী লীগ তাই চায়। তিনি বলেন, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেদের শক্তিতে নির্বাচন করার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। গাজীপুরের ভোট মাথায় রেখেই তিনি বারবার দলের কথা বলেছেন।
নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কাও আছে। এ বিষয়ে দলটির এই নেতা বলেন, যেহেতু সবাই দলের প্রার্থী, তাই আওয়ামী লীগ সভাপতি সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, এটা তার বিশ্বাস। তিনি বলেন, অন্য নির্বাচনের মতো ভোটখরা হলে এ নিয়ে নানা দিক থেকেই জোরালো প্রশ্ন উঠবে। আর যদি ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হয়, তাহলে সব প্রশ্ন বানের জলের মতো ভেসে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে গত ২৩ জুলাই হওয়া ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ।
গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আজমত উল্লা খান নির্বাচন করেছেন। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। নৌকা প্রতীকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে নৌকা হেরে গেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঠিকই জিতেছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ মনে করে, গাজীপুরের ভোটে কোনো খুঁত বের করা সম্ভব হয়নি বলেই গাজীপুর ডিজাইন নিরাপদ।
দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে চায়। এটাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলেও ভোটের উৎসব সৃষ্টি করা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ‘মডেল’ হিসেবে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এ ডিজাইন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যাপারে থাকা বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। গত রবিবার গণভবনে সব মনোনয়নপ্রত্যাশীকে ডেকে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ নেতারা বলেন, চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণার সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়টি মাথায় রেখে ২৯৮ আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। কাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রাখা হবে, কাকে নৌকা দেওয়া হবে এ ছক আগেই করা হয়েছে। কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতবে সেটা মাথায় রেখেই নৌকার দুর্বল প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। দলের নিজস্ব জরিপে ১০০ নম্বর পাওয়া নেতাকে প্রার্থী না করে ৩০ নম্বর পাওয়া নেতাকে প্রার্থী করা হয়েছে। কারণ, ধরে নেওয়া হয়েছে যে, এতে ভোটকেন্দ্রে দুপক্ষের সমর্থকরা বেশি সংখ্যায় আসবে। সবল ও দুর্বল প্রার্থী মিলিয়ে নির্বাচন করা হলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবে। নির্বাচনে উৎসব-আমেজ সৃষ্টি হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের জোট ও অন্য বিরোধীপক্ষ যারাই নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা ৫০টির বেশি আসন পাক তা চায় না ক্ষমতাসীনরা। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর আসন ১০০-এর মধ্যে থাকুক, সেটা চায়। বাকি ১৬০-১৭০ আসন নৌকার প্রার্থী জিতলেই চলবে। এতে করে সরকার পরিচালনায় খুব বেগ পেতে হবে না বলে তারা আশা করেন।
বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা মহলের চাপের মধ্যে নির্বাচন উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক করার চ্যালেঞ্জও নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাই নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে দলীয় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকলেও ভোট গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সরকারের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ওই নেতারা বলেন, গাজীপুরের সিটি ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এতে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হয়নি। নৌকার বিরুদ্ধে জায়েদা খাতুন প্রার্থী হওয়ায় প্রথমে আওয়ামী লীগ বিপাকে পড়েছিল। কিন্তু নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল বলে তারা মনে করেন।
তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ রেখে ভোটের মাঠের বিশৃঙ্খলার দায় কার ওপর বর্তাবে? স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখে ভোট কতটা জমাতে পারবে আওয়ামী লীগ, সেটা নিয়েও ভীষণ গবেষণার ব্যাপার থেকে যায়।’