বাংলাদেশবিএনপিরাজনীতি

খোঁজা হচ্ছে কৌশল, ভোট ঠেকাতে চায় বিএনপি

মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হওয়ায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে সব রকম জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে। একদফায় অনড় থেকে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর এখন ৭ জানুয়ারির ভোট ঠেকানোই মূল লক্ষ্য দলটির। কৌশল নির্ধারণে ইতোমধ্যেই যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করেছে বিএনপি। এ ছাড়া যুগপতের বাইরে থাকা যেসব দল নির্বাচনে যায়নি, নির্বাচন প্রতিহত করতে তাদের সঙ্গেও সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে উচ্ছ্বাস কিংবা আগ্রহ কোনোটিই নেই। এটি ইতোমধ্যেই স্পষ্ট যে, নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। কারণ, নির্বাচনের ফলাফল ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে, মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন বাংলাদেশে চিরতরে ফুরিয়ে গেছে। ক্ষমতার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে এই যে নির্বাচন নির্বাচন খেলা, সেটির পরিণাম কখনোই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য, জনগণের ভোটাধিকার পুনর্বহালের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন চলতেই থাকবে, যতদিন না গণমানুষের এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল পাতানো নির্বাচনের তপশিল বর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বও এই নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতার প্রশ্ন তুলেছে। তারা যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল, সরকার তা আমলেই নেয়নি। ফলে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকও পাঠাচ্ছে না। কারণ, তারা বুঝে গেছে, নির্বাচনের নামে এখানে কত বড় প্রহসন হতে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দেশে জনগণের আন্দোলন কখনোই বৃথা যায়নি, এবারও যাবে না। সরকার মনে করেছে, আগের মতো এবারও একতরফা একটি নির্বাচন করে স্বাচ্ছন্দ্যে ক্ষমতায় থাকবে, সেটা হবার নয়, কেননা এখন ২০১৪ বা ২০১৮ নয়।’

গত ৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ৩০টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ ১৪টি দল ভোটে যায়নি। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) নির্বাচন করছে। শেষদিনে দল দুটির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের সবগুলোই অংশ নিয়েছিল। আর বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল বর্জন করলেও দশম সংসদ নির্বাচনে ১৭টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল।

বিএনপি ও যুগপৎ শরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হওয়ায় এখন আন্দোলনকে দুই পর্বে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথম পর্ব হচ্ছে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় পর্ব হলো ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পর্যন্ত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্দোলনের কর্মকৌশল ও পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে গত কয়েকদিনে দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে বিএনপির হাইকমান্ড। এ ছাড়া সম্প্রতি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে হাইকমান্ড। তারা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন আগামী ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল-অবরোধ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ইতোমধ্যে এই কর্মসূচির ব্যাপারে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল রোববার সকাল থেকে নবম ধাপে দেশব্যাপী ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হবে, যা আগামী মঙ্গলবার ভোর ৬টায় শেষ হবে।

তবে চলমান হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি একঘেয়ে হয়ে যাওয়া এবং জনজীবনে ক্রমেই এর প্রভাব কমে আসায় আন্দোলনকে আরও গতিশীল করতে বিকল্প একাধিক কর্মসূচিও বিএনপির ভাবনায় রয়েছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদের (বিএসপি) উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গার্মেন্ট শ্রমিক হত্যার বিচার, হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, কর্মচ্যুতদের কাজে পুনর্বহাল ও ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণার দাবিতে এই শ্রমিক সমাবেশ হয়। কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ যুগপতের শরিক বিভিন্ন দলের নেতারা ছিলেন।

এর আগে বিএনপির কারাবন্দি, গুম-খুন ও নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীর স্বজনদের নিয়ে তাদের ব্যানারে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন। কারাবন্দি স্বজনদের এই কর্মসূচিকে বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে বিএনপির। এ ছাড়া যুগপতে থাকা দলগুলোর অঙ্গ সংগঠনকে নিয়ে ঢাকায় নারী সমাবেশ, যুব সমাবেশ, শ্রমিক সমাবেশ, ছাত্র সমাবেশের কথাও ভাবছে বিএনপি। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় জনসম্পৃক্ত এসব কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি নেতারা আত্মগোপনে থেকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে ঝটিকা মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে নেতারা বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে সরাসরি মাঠে নামতে পারছেন না। সে কারণে কৌশলের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এসব কর্মসূচি করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন।

তপশিল অনুযায়ী, ১৮ ডিসেম্বর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হবে। তখন পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করবে বিএনপি। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে ফের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি। নির্বাচনের দিন সারা দেশে হরতালের ডাক দেওয়া হতে পারে। তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনের পরও কিছুদিন হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত থাকতে পারে।

এদিকে, আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে সরকারবিরোধী দল ও জোটগুলোকে এক মঞ্চে আনার কথা ভাবছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার যুগপৎ আন্দোলনের সব শরিককে নিয়ে একত্রে বৈঠক করেছে দলটি। আন্দোলন বেগবান করতে সেখানে যুগপতের পরিধি বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে যুগপতে থাকা ৩৯টি দল ছাড়াও বাইরে থেকে এবি পার্টি অংশ নেয়। এ ছাড়া নির্বাচন বর্জন করে যুগপতের বাইরে আন্দোলনে থাকা অন্য দল ও জোটকেও যুগপতে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আলোচনা হয়েছে ‘একতরফা’ নির্বাচন ঠেকানোর কর্মকৌশল নিয়েও। এর অংশ হিসেবে তপশিল বাতিলের দাবির পাশাপাশি ভোটারদের ভোট বর্জন করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, শিগগির আবারও বৈঠকে বসবে যুগপতের ৩৯ দল। সেখানে যুগপতের বাইরে থাকা বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং সমমনা ইসলামী দলগুলো নামের মোর্চাকেও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে।

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দুজন শীর্ষ নেতা বলেন, সরকার একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় একদফার আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে যুগপতের পরিধি বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন বর্জন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোকে যুগপতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করা হচ্ছে। যদি যুগপতে সম্পৃক্ত হতে রাজি না হয়, তাহলে তারা আগের মতো নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলন করবেন।

বাম গণতান্ত্রিক জোট ছাড়া অন্য দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তারা জানান।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোকে নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমরা যে ঐক্যবদ্ধ, তা এই বৈঠকে প্রমাণ হলো। এর বাইরেও যেসব দল নির্বাচনে যায়নি, তাদের যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হবে।’

এদিকে নির্বাচন ঠেকানোর কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি ও শরিকদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। জানা গেছে, ভোট বর্জনের এই আহ্বান অব্যাহত রাখা হবে। বিএনপি ও শরিকদের লক্ষ্য, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ন্যূনতম করা।

তারা মনে করছেন, ভোটাররা একতরফা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে ভোট ঘিরে উৎসব-আমেজেও ভাটা পড়বে। সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা গেলে নির্বাচন বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

Back to top button