সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থেকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে রাজপথে আছে বিএনপি। প্রলোভন কিংবা ভয় দেখিয়ে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করেছে সরকার। তাতে সরকার সফল হয়নি বলেই বিএনপির বিশ্বাস।
দলটির নেতারা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে তারা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। তার নির্দেশনায় গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের ঐকান্তিক চেষ্টায় দলের ভাঙন ঠেকানো গেছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত নেতাদের আত্মগোপনে থাকার নির্দেশ ছিল। এরপরও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একেএম একরামুজ্জামান সুখন, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে চাপে ফেলে নির্বাচনে নিতে পেরেছে সরকারপক্ষ।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সারা দেশে ১২ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগেই বলেছিলেন জনগণের ভোটাধিকার ও মানবাধিকারসহ সংবিধানস্বীকৃত দাবি আদায়ের আন্দোলনের বুকে ছুরি মেরে যারা নির্বাচনে যাবেন, তারা জাতীয় বেইমান।’
গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের ১৫ নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তাদের ৮ জন কেন্দ্রীয় নেতা ও ৭ জন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতা। রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় ৮ নেতা হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ একে একরামুজ্জামান, তাঁতীবিষয়ক সহসম্পাদক রাবেয়া ভূঁইয়া, নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, শাহ শহীদ সারোয়ার, মতিউর রহমান মন্টু, খন্দকার আহসান হাবিব ও একেএম ফখরুল ইসলাম।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৭ জন হলেন শেরপুর জেলা বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক জায়েদুর রশিদ শ্যামল, সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ, পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য আব্দুল আজিজ, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য মাহবুবুল হাসান, ঢাকার ধামরাই পৌর বিএনপির সভাপতি দেওয়ান নাজিম উদ্দিন মঞ্জু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আবদুল মতিন ও গতকাল বিকেলে বহিষ্কৃত জামালপুর জেলা বিএনপির সদস্য ও ইসলামপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি হোসেন রেজা বাবু।
এর বাইরে দলের সাবেক কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তারা হলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, দলের বহিষ্কৃত নেতা শওকত মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিএনপির সাবেক নেতা নাজিম উদ্দিন, বগুড়ার মোহাম্মদ শোকরানা, বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গত বৃহস্পতিবার। এ দিনটির অপেক্ষাতেই ছিল বিএনপি। এ কথা উল্লেখ করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘সরকার ১৪ বছরের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নামে দুটি দল তৈরি করেছে। বিএনপি নির্বাচনে না গেলে দলটির নেতাদের ভয় কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে নতুন সৃষ্টি করা কিংস পার্টির মাধ্যমে নির্বাচন করাবে সরকারপক্ষ। বিশ^বাসীকে দেখাবে বিএনপির নেতারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ আমাদেরও পাল্টা কৌশল ছিল। তা ছাড়া বিএনপির ঐক্য পাথরের মতো দৃঢ়; আওয়ামী লীগ কিংবা ডিনামাইট দিয়ে দলে কেউ ভাঙন ধরাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। সরকারের দল ভাঙার কৌশল জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে।’
বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। দেশজুড়ে অনেক নেতার বাসায় অভিযান চালানো হয়। নেতাকর্মীরা বাড়ি-ঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে। এ অবস্থায় ঘোষণা করা হয় জাতীয় নির্বাচনের তফসিল। নেতাদের নির্বাচনে নিতে টোপ, প্রলোভন দেখানো হয়েছে। রেহাই পাননি কারাবন্দি নেতারাও। এর প্রমাণ ঝালকাঠি-১ আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বিএনপির বহিষ্কৃত ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর নেতাদেরও টোপ দেওয়া হয় নানা মাধ্যমে। ‘কিংস পার্টি’র বড় পদের লোভ দেখানো হয়। তবে চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা।’
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘আত্মগোপনে থাকা নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এমন সম্ভাব্য নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গেও বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন তারেক রহমান। তারা তারেক রহমানের ওপর আস্থা রেখেছেন। তাদেরও টলানো যায়নি। যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত কয়েকটি দলের প্রধানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা। শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেও তাদের নির্বাচনে আনা যায়নি। তারা বিএনপির নেতৃত্বে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে যুক্ত আছেন।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সহসভাপতি ডা. শহিদুল আলমকে কিংস পার্টিতে যোগ দেওয়ানো হতে পারে বলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছিলেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে সাতক্ষীরায় তার বাড়িতে অভিযান চালান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
শহিদুল আলম গতকাল বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নিতে আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তৃণমূল বিএনপি অথবা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমাকে নির্বাচনে নিতে পারেনি সরকার।’
বিএনপির দপ্তর সংশ্লিষ্ট নেতারা বলেন, ‘চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে তৃণমূল নেতারা যেমন রাজপথে রয়েছেন, তেমনি কোনো নেতার গতিবিধি সন্দেহজনক হলে দপ্তরে যোগাযোগ করছেন তারা। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম, খন্দকার তৈমূর আলমসহ অন্য যারা নির্বাচনে গেছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নিজ নিজ এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হবে তাদের।’
তারা বলেন, ‘সরকারের ভয়, প্রলোভন দেখিয়েও বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকে নির্বাচনে নিতে পারেনি। তবে শাহজাহান ওমর, একেএম একরামুজ্জামান সুখনকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করতে পেরেছে। একজন বার্ধক্যজনিত কারণে ও আরেকজন ব্যবসায়িক কারণে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।’