বিএনপি কি ‘ডামি তত্ত্বের’ সুযোগ নিতে পারবে?

এইচ এম এ হক বাপ্পি: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক গবেষক

এ মুহূর্তে দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনী প্রেক্ষাপট এবং গতিপথ এক নজিরবিহীন ‘টার্নিং পয়েন্টে’ অবস্থান করছে। বিষয়টির সূচনা গত ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের তালিকা প্রকাশের আগে গণভবনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী সবার সঙ্গে সভা থেকে। সভায় ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ যেন নির্বাচিত হতে না পারে’ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্য দেশের রাজনীতির মোড় একেবারে ঘুরিয়ে দিয়েছে। সভায় দলীয় এবং দেশের সরকার প্রধানের এমন অভূতপূর্ব এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী এ নির্দেশনা এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সকল হিসাব-নিকাশকে নতুন সমীকরণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় সুনির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সর্বশেষ এই ‘ডামি তত্ত্বের’ মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক তথা জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিতের পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়ে নির্বাচন নিয়ে নানান শঙ্কা এক মুহূর্তে উধাও করে নির্বাচনকেন্দ্রিক দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আবারও পুর্নব্যক্ত করলেন।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি একটু পেছনে তাকালেই দেশের জনসাধারণ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক তথা জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিতকরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের বিশেষ কৌশলগত অবস্থান দেখে আসছে। একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে জোটবদ্ধ বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধীদলসমূহের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একদফা দাবিতে চলমান লাগাতার সভা-সমাবেশ আর আন্দোলনও দেখছে তারা। আর এর ঠিক বিপরীতমুখী অবস্থানে বরাবরই অনড় ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট। এরই ভেতরে তফসিল ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণার ফাঁকেও দেশের সাধারণ জনগণের কাছে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নানান শঙ্কা এবং দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছিল। ‘আবারও কি একপেশে নির্বাচন? আবারও কি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হবার কারণে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ হারাবে?’ গণতন্ত্রের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেওয়া এমন কিছু প্রশ্ন প্রায় সবার মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঠিক এমন সময়েই বঙ্গবন্ধু কন্যার দেওয়া বিকল্প প্রার্থী (ডামি) রাখার দলীয় পরামর্শের মাধ্যমে তিনি জনগণের ভোটাধিকারকে সমুন্নত রাখার পাহাড়সম প্রত্যয়কে আবারও পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

ফলস্বরূপ এখন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া প্রার্থীদের বিকল্প প্রার্থী (ডামি) রাখার দলীয় পরামর্শের রাজনৈতিক সমীকরণ অনুসারে এখন কী করণীয় তা পরিষ্কার। একইভাবে, বিএনপিসহ বিরোধীদলের নিকটও কিন্তু নিবাচনে অংশগ্রহণ করার এমন বার্তাই পৌঁছাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিদ্রোহী তকমা দেওয়া হবে না বলে আমরা জেনেছি। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করতেও নৌকার প্রার্থীদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী হতে এই বার্তাই এখন নৌকাবঞ্চিতদের অনুপ্রেরণার জায়গা। তাই নৌকাবঞ্চিতদের অনেকেই লড়বেন নৌকার বিপক্ষে।

একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যমতে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতানুসারে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, এবার আগে থেকেই নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এতে করে মাঠে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরি করতে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অনেক আসনে প্রার্থী বদলের ইঙ্গিত ছিল। তাই আগে থেকেই নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক জনসংযোগ করেছেন নেতারা। বর্তমান সংসদ সদস্যের বিপক্ষে মনোনয়ন পেতে অর্থ খরচও করেছেন প্রচারে। এ ছাড়া তাদের যারা প্রচারে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের প্রতিও দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এখন স্বতন্ত্র প্রার্থীতার সুযোগ থাকায় তারা ভোটের মাঠে থাকতে চাইছেন। আবার বর্তমান সংসদের ৭১ জন সদস্য নৌকার মনোনয়ন হারিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, নৌকার বিপক্ষে লড়েও জয় পেতে পারেন তারা। তাই তারাও এবার লড়তে পারেন নৌকার বিপক্ষে।

হিসাবমতে, বিএনপিসহ অন্যান্য সকল নির্বাচন বিমুখ দলসমূহকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আসতে তাদের কোর্টে ‘বল’ ঠেলে দিয়েছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নিজ দলে ডামি প্রার্থী তৈরি করতে বা স্বতন্ত্র প্রার্থীতাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করছে এটি বিএনপিসহ সকল বিরোধী ও নির্বাচনবিমুখ রাজনৈতিক দলের জন্যও শুভ বার্তা। তাছাড়া, বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের নির্বাচনে আসার পথ সুগম রাখতে কয়েকদিন আগেই তফসিল পেছানোর সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। বিরোধীদলসমূহের শক্ত অবস্থানের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের এমন আনকোরা রাজনৈতিক কৌশলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট আদায়ের এটা বিএনপির সর্বশেষ মোক্ষম সুযোগ বলে আমার ধারণা।

প্রধানমন্ত্রীর এমন সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত কি শুধুই নিজ দলের জন্য? তা অবশ্যই নয়। একটি দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধীদল এবং বার কয়েক দেশ পরিচালনাকারী দল বিএনপিসহ অন্যসকল রাজনৈতিক দলের এটি ভুললে চলবে না যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সকলেই সাংবিধানিকভাবেই অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী: ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।’ একইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার মূল ভিত্তিই হলো জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যার জন্য আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন। তাছাড়া বাংলাদেশ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবেও অঙ্গীকারবদ্ধ।

সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি নির্বাচিত না হলে এ বিষয়সমূহের যে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয় তা প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল জানেন এবং মানেন বলেই আরও একবার এমন উদারপন্থী সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পেরেছেন।

বিএনপিকে ঠিক নির্বাচনপূর্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন সময়টাতে মাঠের রাজনীতি ছেড়ে ঠিক আওয়ামী লীগ সভাপতির মতো কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। বিএনপির অবস্থান ও ভবিষ্যৎকে মাথায় রেখে এবং এই দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বাংলাদেশের মানুষকে উপহার দেবেন কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়।

Exit mobile version