ভোটার উপস্থিতি ঠেকানোর পরিকল্পনায় বিএনপি ও মিত্ররা

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন অতিবাহিত হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। ভোটে না যাওয়ায় চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের বাইরে থাকল বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা। এখন প্রশ্ন জেগেছে, বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো আন্দোলন কিংবা কর্মসূচি নিয়ে কী চিন্তা করছে? তারা কীভাবে এগিয়ে যাবে? এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন বেগবান করার পাশাপাশি দলীয় নেতাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে ‘ব্যাপকভাবে’ মাঠে নামার লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার সমমনা জোট ও দলের নেতাদের সঙ্গে যৌথসভা করেছে দলটি। এতে ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয় বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার যে কোনোভাবে নির্বাচনকে দৃশ্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার কথা ভাবছে। সরকার যেন তা সহজভাবে করতে না পারে, সেই অনুযায়ী তারা পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন।

এদিকে আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ একদফা দাবিতে এবং তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে আগামী ৩ ডিসেম্বর ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ৫ ডিসেম্বর ভোর ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। একই সঙ্গে আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শ্রমিক সমাবেশ করবে দলটি।

অন্যদিকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘চাপ ও লোভ’-এ একজন ছাড়া দলের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্বাচনে অংশ নেননি। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমমনা দুটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্য কোনো দলও নির্বাচনে যায়নি। বিএনপি নেতারা জানান, তাদের দলের সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি ও সমমনা দল। কিন্তু সরকারের ‘চাপ ও লোভ’-এর কারণে বিএনপি ও সমমনা নেতাদের নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তারের পর এই গুঞ্জনের ডালপালা মেলে। এতে করে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চিন্তায় পড়ে যান। গতকাল ৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। নির্বাচনে না যাওয়ায় চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের বাইরে থাকল বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, শেষ দিন পর্যন্ত দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম আওয়ামী লীগ থেকে, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ একে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। সমমনা দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলীম লীগ ছাড়া অন্য দলও নির্বাচনে যায়নি। নির্বাচনে যায়নি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোটও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এতে করে দলটির শীর্ষনেতৃত্ব হাঁফ ছেড়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, প্রথমত, দলের সিনিয়র নেতা থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী সবাই বিএনপির সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচনে না গিয়ে আন্দোলনের পথেই আছেন। নির্যাতন-গ্রেপ্তারের মাঝেও বিএনপি যে ঐক্যবদ্ধ- তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো আন্দোলনের পথে রয়েছে। এটা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত দলগুলোর বড় সফলতা। আমরা মনে করি, এটি আগামী দিনে আন্দোলনের গতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী দলগুলোর সিদ্ধান্ত ছিল- দুই পর্বে ভাগ করে আন্দোলনের চলমান কর্মসূচি প্রণয়ন করা। প্রথম পর্ব মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল। এ পর্ব চলবে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের শেষ দিন (৪ ডিসেম্বর) পর্যন্ত। এরপর শুরু হবে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্ব চলবে ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পর্যন্ত।

বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বিতীয় পর্বে কী ধরনের কর্মসূচি থাকছে, এ নিয়ে এখনো বিএনপি ও শরিক দলগুলোর আলোচনা চলছে। বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা ও দলটির স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অন্যান্য দল ও প্রার্থীদের দ্বন্দ্ব নির্বাচনের মাঠকে সংঘাতময় করে তুলবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ওপর নজর রাখবে দলটি। বিএনপি সূত্রে জানা যায়, গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পার করে নিয়মিত বৈঠক করেছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। এ ব্যাপারে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদলগুলোকে নিয়ে বৈঠক করলাম। একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমরা যে ঐক্যবদ্ধ তা আজকের বৈঠকে প্রমাণ হলো। তা ছাড়া আমাদের বাইরে নির্বাচনে যায়নি- এমন দলগুলোকেও যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হবে।

৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের দাবি

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তফসিল বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল বিকালে রাজধানীর তোপখানা রোডের শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে এক যৌথসভায় এ দাবি জানানো হয়। জাতীয় পার্টির সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দারের সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে তা বাতিলের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

বৈঠক থেকে সরকার ও সরকারি দলের সব ধরনের উসকানি, সহিংসতা ও পরিকল্পিত নাশকতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে চলমান গণআন্দোলন গণসংগ্রামকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই সভায় আরও অংশ নেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের (নুর) সভাপতি নুরুল হক নুর, এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম প্রমুখ নেতা।

Exit mobile version