‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না’, বক্তব্যটি সুশীল সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলে খেলাধুলা আদ্যন্তই রাজনৈতিক ব্যাপার। জাতীয় দলের খেলা যখন হয়, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা দুই দলের ১১ দু গুণে ২২ জনে আর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং দুটো দেশ জড়িয়ে পড়ে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, কিংবা বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ যখন মুখোমুখি হয়, তখন আর ব্যাপারটা ফুটবলে সীমাবদ্ধ না থেকে পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া ‘বাঙাল’দের সঙ্গে কলকাতার ‘ঘটি’দের যে সামাজিক বিভাজন কিংবা স্প্যানিশ অভিজাতদের সঙ্গে স্বাধীন চেতা কাতালানদের যে দ্বৈরথ এই সবকিছুই জড়িয়ে যায়। এভাবে খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশতে মিশতে খেলোয়াড়রাও মিশে গেছেন রাজনীতির স্রোতধারায়। ইমরান খান, জর্জ উইয়াহ নিজ নিজ দেশের শীর্ষ নির্বাহীর পদ অলংকৃত করেছেন। তবে সেসব মাঠের খেলা ছাড়ার পর। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা খেলার মাঠ এবং রাজনীতির ময়দান, দুটোতেই একসঙ্গে থাকতে চাইছেন। উদাহরণটা তৈরি করেছিলেন মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। তার দেখানো পথে সাকিব আল হাসানও হতে চাইছেন সংসদ সদস্য। সাকিবের নাম যেদিন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলোয়াড় তালিকা থেকে কাটা পড়ল, সেদিনই তিনি পেয়েছেন আওয়ামী লীগের জয়ে মাগুরা-১ আসনে নির্বাচন করার মনোনয়ন। তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের হয়েছে ভরাডুবি, চোটের কারণে খেলছেন না নিউজিল্যান্ড সিরিজেও। আঙুলের চোট সারলেও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ফেলে নিশ্চয়ই গোটা ডিসেম্বর মাস নিউজিল্যান্ডে কাটাবেন না। তাই বলা যায় ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজও সাকিব খেলবেন না। এক সাক্ষাৎকারে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ার দেখছেন ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত। তার মানে আরও বছর দেড়েক অন্তত জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেখছেন সাকিব। এর বাইরে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, ব্যবসায়িক ব্যস্ততা, মার্কিন মুল্লুকে পরিবার সবাইকে সময় দেওয়ার পর রাজনীতির জন্য কতটা সময় সাকিব বের করতে পারবেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তার ওপর বলা যায় আগের কোনো প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বা অংশগ্রহণ ছাড়াই যখন মনোনয়ন পেয়ে যান, তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি যারা দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন তাদের প্রতি অন্যায় হলো না?
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন করা আবদুল্লাহ কাফি রতন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাকিব মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করেছেন, এর আগে মাশরাফীকেও আমরা সংসদ সদস্য হিসেবে দেখেছি। যারা খেলোয়াড়ি জীবন শেষ না করে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা তাদের খেলোয়াড়ি জীবনের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছেন। এটা গ্রহণযোগ্য না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে খেলোয়াড়রা রাজনীতি করতেই পারেন, তবে সেটা খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে। রাজনীতি তো হঠাৎ করে এসে নির্বাচন করার বিষয় নয়, রাজনীতি হচ্ছে তৃণমূল থেকে মানুষের সেবা করে করে একটা জায়গায় আসার ব্যাপার। এখানে যেটা হচ্ছে, তাদের একটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উচ্চাকাক্সক্ষা কাজ করছে। তার সঙ্গে মিলে গেছে বর্তমানের নির্বাচন প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তাই এখন চিত্রনায়ক, খেলোয়াড় এদেরকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে একটা চমক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এই দুইয়ের সমীকরণ মিলেই রাজনীতির মাঠে অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে খেলোয়াড়, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।’
ফুটবলের জনপ্রিয়তা যখন বাংলাদেশে তুঙ্গে ছিল, তখন বাদল রায় ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। হয়েছিলেন ক্রীড়া সম্পাদকও। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে তিনি আসেননি। আরিফ খান জয় সংসদ সদস্য হয়েছেন, ক্রীড়া উপমন্ত্রীও হয়েছেন। খেলোয়াড়ি জীবনের পর রাজনীতির মাঠেও সফল হয়েছেন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ, সালাম মুর্শেদিরাও। মাশরাফীও যখন সংসদ সদস্য হয়েছেন তখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে, শুধুই ওয়ানডে খেলেন। টেস্ট এবং আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেন না। সাকিব ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে নেই, তবে এখনো ফুরিয়ে যাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে কেউই রাজনীতিতে আসতে পারেন। তবে জাতীয় দলের অংশ হিসেবে তখন বিরুদ্ধ অংশের শ্রদ্ধাটুকু হয়তো তাকে হারাতে হবে, ‘যারা বিভিন্নভাবে মানুষকে বিনোদন দেন তারা মানুষের ভালোবাসা পেয়ে থাকেন এবং সেটা কাজে লাগিয়ে রাজনীতির জগতেও পা রাখেন। কেউ কেউ একবারের জন্য আসেন, যেমন অমিতাভ বচ্চন। কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদে আসেন। এই প্রথাটা প্রচলিত। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা আসছেন তারা যদি সমাজে নিজেদের যে জনপ্রিয়তা সেটাকে পুঁজি করে আসেন তাহলে রাজনীতি উপকৃত হবে না। তবে জনগণের মঙ্গলকামনায় যেকোনো দলের হয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া মেনে যদি রাজনীতিতে আসেন এবং নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে জনগণের জন্য কাজ করেন, তাহলে জনগণ উপকৃত হয়। তবে এ ধরনের মানুষদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী প্রভাব হচ্ছে, বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে লম্বা সময় ধরে তৃণমূলে প্রচুর মানুষ কাজ করে। বলা যায় জীবন সম্পদ সবকিছুই তারা দলের জন্য উৎসর্গ করেন বলা যায়। সেই জায়গায় উড়ে এসে জুড়ে বসারা উচ্চপদে আসীন হলে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।’
এই সময়ে এসে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করাটা হয়ে উঠেছে কঠিন। সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, ব্যবাসায়ীরাই এগিয়ে। সাকিবও ক্রিকেটার পরিচয় ছাপিয়ে ব্যবসায়ী হিসেবেও নিজের পরিচিতি বিস্তৃত করছেন, তবে সেই সব অভিজ্ঞতা তার জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনেনি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছিল মানব পাচারের অভিযোগ, কাঁকড়ার খামারের শ্রমিকদের বেতন দেননি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে এসেছে নাম ও দিয়েছেন জরিমানা, রেস্তোরাঁও হয়েছে বন্ধ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি করে আর ঋণখেলাপি হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে আছেন ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে। ব্যাংকের লাইসেন্স চেয়ে পাননি, সোনার ব্যবসায় নেমেছিলেন কিন্তু সেটাও সোনা আমদানির লাইসেন্সে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করায় বিএসইসি দিয়েছে কারণ দর্শানোর নোটিস।
সাকিব যদি ব্যাটের বদলে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকার মাঝি শেষ পর্যন্ত হয়েই যান, তাহলে কি এসব বিতর্কিত কর্মকান্ড থামিয়ে দেবেন না আরও বেশি করে করবেন, এই প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় সাকিব নিজেও দিতে পারবেন না। কারণ কখন কোথায় তাকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়, সেটা বোধ হয় তিনি নিজেও জানেন না।
রাজনীতিতে আসার আগেও মাশরাফী যতটা মানুষের কাছাকাছি ছিলেন, তার পারিবারিক ঐতিহ্য যতটা ছিল গণমানুষের সেবা করার, সাকিব তার পুরোটাই বিপ্রতীপ। ভক্তকে মারা, ফোন ভেঙে ফেলা, ব্যাট দিয়ে মারার ভঙ্গি করা, টুপি দিয়ে মারা এসব তার নিয়মিত কর্মকান্ড। ব্যাংক কর্মকর্তা বাবার রাজনৈতিক কর্মকা- বা পারিবারিক আবহের কথাও মাগুরার রাজনৈতিক পরিমন্ডলের কেউ জানেন না। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমি ৩৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সময়ে আমি কখনো সাকিব বা তার পরিবারের কাউকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা দেখিনি। তাদের এই দলের প্রতি কোনো কন্ট্রিবিউশন (অবদান) আছে বলেও মনে হয় না।’
সাকিবের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নতুন নয়। ২০১৯ সালের নির্বাচন কিংবা কিছুদিন আগে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনেও তার প্রার্থী হওয়ার গুঞ্জন ছিল। এবারে গুঞ্জন নয় সত্যি মনোনয়ন পেয়েছেন সাকিব, ৩ আসনের ফরম কিনে মনোনয়ন পেয়েছেন একটি আসনে। যে আসনে তিনি ভোটারই নন! সাকিব হয়তো জিতেই যাবেন, তবে এতে করে ভক্তদের একটি অংশের সমর্থন তিনি হারাবেন এমনটাই মনে করেন অধ্যাপকক গোবিন্দ চক্রবর্তী, ‘জাতীয় দল একটি অখন্ড ভাবনা। দল মতের ঊর্ধ্বে। কেউ একজন যখন নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী হবেন, তখন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দর্শনের মানুষেরা যে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তবে রাজনীতিতে যিনি বা যারা আসছেন, এইটুকু বাস্তবতা মেনে বা ত্যাগ স্বীকার তো তাদের করতেই হবে।’