নির্বাচনবাংলাদেশরাজনীতি

আ.লীগের বিদ্রোহী দুই ডজন এমপি, যারা বেশ কয়েকবারের নির্বাচিতও

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত ৭১ জন সংসদ সদস্যের (এমপি) মধ্যে দুই ডজনই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন। দলীয় এমপিদের স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পদত্যাগ করতে হবে না, নির্বাচন কমিশনের এমন ঘোষণার পর এই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে। এরইমধ্যে অনেকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। জমাও দিয়েছেন কেউ কেউ। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমপিরা বিদ্রোহী হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।

তবে মনোনয়নবঞ্চিত এমপিরা নিজেদের বিদ্রোহী বলতে নারাজ। তারা নিজেদের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবেই দাবি করছেন। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে তাদের যুক্তি, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে দলের বিরোধিতা নয়। অনেকে বলছেন, দলের নেতা-কর্মীদের অনুরোধেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই পথে যেতে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রীর মত রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত বর্তমান সংসদের ২৪ জন সদস্য নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছেন হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আবদুল মজিদ খান। এবারও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন, কিন্তু দল তাকে দেয়নি। গত মঙ্গলবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। সংসদ সদস্যের পক্ষে তার ব্যক্তিগত সহকারী সেলিম আহমেদ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।

মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) জাফর আলম। তিনি বলেন, যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে উনি নৌকাকে তিন- তিনবার ডুবিয়েছেন। তার কোনো যোগ্যতা নেই। এই আসনটি আমি বিএনপি-জামায়াত থেকে উদ্ধার করেছি। এই আসনে বিএনপি নেতারা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য নির্বাচন করছি। এই আসনে আমি জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে চাই।

ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন। একই জেলার ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহম্মেদও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের চাওয়া পূরণ করতেই তারা মাঠে নামছেন বলে জানান।

কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র তুলেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ও তার ছেলে সাফায়াত বিন জাকির। মঙ্গলবার বিকালে রৌমারী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে তারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।

রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে বর্তমান এমপি আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি এনামুল হক, কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম, কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-তিতাস) আসনে বর্তমান এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভুঁইয়া ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

গাজীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ। ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন ওই আসনের বর্তমান স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।

চট্টগ্রাম-১২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ-১ আসনে এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সুনামগঞ্জ-২ আসনে এমপি ড. জয়া সেনগুপ্তা, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না, জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধনুট) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন মনোনয়ন বঞ্চিত এমপি হাবিবর রহমানের ছেলে ধনুট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ইকবাল সনি, নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সাংসদ ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল মজিদ খান দলীয় টিকিট না পেলেও স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। তিনি ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এবাদুল করিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান (চঞ্চল) দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরে কর্মী-সমর্থকদের দাবির মুখে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন।

সাতক্ষীরা-২ (সাতক্ষীরা সদর) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সদর উপজেলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু। এ আসনের দুবারের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। তিনি মনোনয়ন পাননি। তাই এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চান। মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বলেন, কর্মীরা যেহেতু চাচ্ছে, আমি নির্বাচন করি। তাই তাদের কথামতো আমি নির্বাচন করতে ইচ্ছুক।

এদিকে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানা। গতকাল বুধবার বিকাল ৩টায় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়িবহরের শোডাউনের মাধ্যমে সহকারী রিটারনিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরতিজা হাসানের কাছে মনোনয়পত্র দাখিল করেন। রানা এ আসনের বর্তমান এমপি আতাউর রহমান খানের ছেলে। তিনি এ আসন থেকে দুইবার এমপি নির্বাচিত হন। প্রথমবার ২০১২ সালের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় এ আসন থেকে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ছেলের আসনে বাবা আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু এবার তাকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত হয় খান পরিবার। যে কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের ঘোষণা দেন তিনি।

দলীয় এমপিদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা নেই: এদিকে দলীয় সংসদ সদস্যদের (এমপি) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে না বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি জানায়, দলীয় হোক, নির্দলীয় হোক বা সংরক্ষিত নারী আসনের হোক, সংসদ সদস্য পদে থেকেই দলীয় এমপিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন।

গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ শাখার পরিচালক মো. শরিফুল আলম এ তথ্য জানিয়ে বলেন, কোনো নির্দলীয় সংসদ সদস্য নির্দলীয়ভাবে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হলে তাকে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হলে শর্তগুলো পরিপালন করতে হবে।

মো. শরিফুল আলম জানান, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন সম্বলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। তবে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী ইতোপূর্বে জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে তালিকার প্রয়োজন হবে না।

Back to top button