ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ বিগো এবং লাইকির আড়ালে অর্থ পাচার মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন বিএনপি নেতা শিল্পপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টুর তিন ছেলে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দিতে যাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এতে এক চীনা নাগরিকসহ আরও ১৫ জনকে আসামি করা হতে পারে। সিআইডির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিআইডি জানায়, চীনের ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ বিগো লাইভ ২০১৯ বাংলাদেশে ‘বিগো বাংলা’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। তারা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ভিডিও স্ট্রিমিং ও গেমিংসহ বিভিন্ন ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবসার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস্তবে কোম্পানিটি নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে অনৈতিক ভিডিও চ্যাটিং, অনলাইন জুয়া, নিষিদ্ধ গেমিং এমনকি ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচার মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে ঘটনার তথ্যপ্রমাণ উঠে এলে ভিগো বাংলার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গত বছর ২৫ নভেম্বর অর্থ পাচার আইনে গুলশান থানায় এ সংক্রান্ত মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
যেভাবে অর্থ পাচার : বিগো বাংলা ও লাইকি অ্যাপে লাইভ চ্যাটিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেবা নিতে ‘ডায়মন্ড’ ও ‘বিনস’ নামের ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনতে হয়। এক্ষেত্রে অ্যাপসে দেওয়া বিকাশ বা রকেট নম্বরে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠালে ‘ডায়মন্ড’ বা ‘বিনস’ পাওয়া যায়। অবৈধ পন্থায় অর্থ হাতিয়ে নিতে কোম্পানিটি নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড শুরু করে।
সিআইডি বলছে, বিগো বাংলার আপসে ডেটিং সাইটের মতো বিতর্কিত সেবা দেওয়া হয়। এজন্য নানা বয়সের উঠতি তারকা বা কথিত মডেলদের ব্যবহার করা হয়। মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভনে তাদের ভিডিও ক্যামেরার সামনে অশ্লীল আলাপে বাধ্য করা হয়। এমনকি ভিউ বাড়াতে তাদের অশ্লীল চ্যাটিং লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) করে বিগো বাংলা।
তদন্তে উঠে আসে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিগো গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে তরুণ-যুবকদের অনেকেই প্রলুব্ধ হন। একপর্যায়ে তাদের অনেকে বিগো বাংলার ভার্চুয়াল মুদ্রা তথা ‘ডায়মন্ড’ ও ‘বিনস’ কিনে অশ্লীল লাইভ চ্যাটে অংশ নেন। এভাবে মাত্র দেড় বছরে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে শতকোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, অবৈধ উপায়ে অর্জিত বিগো বাংলার বিপুল অঙ্কের অর্থ সিঙ্গাপুর হয়ে কয়েকটি দেশে পাচার করা হয়। এ কাজে কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তা করে। এর মধ্যে বিএনপি নেতা ও শিল্পপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টুর মুনসুন হোল্ডিংস অন্যতম। বর্তমানে মুনসুন হোল্ডিংসের পরিচালক হিসাবে কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করেন তার তিন ছেলে-তাফসির এম আউয়াল, তাবিথ আউয়াল ও তাজওয়ার এম আউয়াল। তদন্তকালে বিগো বাংলার অর্থ পাচারে তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিআইডি বলছে, অর্থ পাচারে অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হয়। প্রথমে বিগো বাংলার উপার্জিত অর্থ সংগ্রহ করে ‘সূর্য পে’ নামের একটি পেমেন্ট গেটওয়ে। অথচ তাদের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তি ছিল না। পরে টাকা চলে যায় সূর্য পে’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান মুনসুন হোল্ডিংস অ্যাকাউন্টে। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে অর্থ পৌঁছে যায় বিগো বাংলার হাতে। একপর্যায়ে উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ সিঙ্গাপুর হয়ে বিদেশে চলে যায়।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, মামলার প্রাথমিক এজাহারে আসামির তালিকায় আব্দুল আউয়াল মিন্টুর তিন ছেলে তাফসির এম আউয়াল, তাবিথ আউয়াল ও তাজওয়ার এম আউয়ালের নাম ছিল না। কিন্তু তদন্তকালে অপরাধের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। এ কারণে তাদের আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া আসামির তালিকায় থাকছেন সূর্যমুখী লিমিটেডের চেয়ারম্যান এসএম আশিকুজ্জামান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজতবা ফিদাউল হক, পরিচালক জামিল আহমেদ এবং ইউজিআই লিমিটেডের চেয়ারম্যান জাকির খান। আসামিদের অন্যরা হলেন বিগো বাংলার মালিক চীনা নাগরিক ইয়াও জি, ব্যবসা উন্নয়ন ম্যানেজার মোস্তফা সাইফ চৌধুরী ওরফে অনি, এসএম নাজমুল হক ও আসমাউল হুসনা সেঁজুতিসহ বিগো বাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্ত চলাকালে বিগো এবং লাইকি আ্যপসের একাধিক সাবসক্রাইবার বা ব্যবহকারীর বক্তব্য নেয় সিআইডি। এর মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় নেওয়া ২৩ জনের বক্তব্য চার্জশিটে উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ এদের সবাই বিগো বাংলার ভার্চুয়াল মুদ্রা তথা ‘ডায়মন্ড’ ও ‘বিনস’ কিনতে বিভিন্ন মোবাইল থেকে টাকা পাঠান।
তাহের খান নামের এক ব্যবহারকারী বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ব্যবসা করেন। বিগো লাইভ এবং লাইকি অ্যাপস ব্যবহারকালে মোবাইলে বিভিন্ন অশ্লীল ভিডিওর বিজ্ঞাপন দেখতে পান তিনি। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে বেশ কয়েকটি মোবাইল নম্বর আসে। যেখানে টাকা পাঠিয়ে ‘ডায়মন্ড’ বা ‘বিনস’ কিনলে মূল ভিডিও দেখা যায়।
মোজাম্মেল হোসেন শেখ নামের অপর এক ব্যবহারকারী বলেন, তিনি পেশায় রংমিস্ত্রি। বিগো-লাইকি অ্যাপস দিয়ে তিনি মোবাইলে তিন পাত্তি (জুয়া) গেমস খেলতেন। এজন্য বিগো অ্যাপসে দেওয়া মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠিয়ে ‘চিপস’ বা ডিজিটাল মুদ্রা কিনতেন তিনি। তবে এখন তিনি বিগো-লাইকি অ্যাপস ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন।
নওশিন নামের এক গৃহিণীর বক্তব্যে বেশ কয়েকটি নিষিদ্ধ গেমসের ভয়াবহতা উঠে আসে। নওশিন বলেন, মোবাইলে বিভিন্ন গেমস খেলতেন তিনি। বিশেষ করে এইট পুল ও পাবজিসহ বিভিন্ন গেমসে আসক্ত ছিলেন। অনলাইনে এসব গেমস খেলতে ভার্চুয়াল চিপস দরকার হয়। তিনি গিফট কার্ড মিন্টস নামের এক ওয়েবসাইট থেকে চিপস বা ডায়মন্ড কিনতেন। ওই সাইটে দেওয়া মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠালে ডায়মন্ড বা বিনস পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, এভাবে অ্যাপসের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ভার্চুয়াল মুদ্রা বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে বিদেশে পাচার হয় প্রায় একশ কোটি টাকা। মূলত বিগো বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইয়াও জি তার ব্যবসায়িক অংশীদার এসএম নাজমুল হকের সহায়তায় বিপুল পরিমাণ অর্থ সিঙ্গাপুর হয়ে অন্য কোনো দেশে পাচার করেন।
সিআইডি জানায়, ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে লেনদেন হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থের হদিস মেলেনি। এছাড়া বেশ কিছু অর্থ কমিশন হিসাবে থার্ড পার্টি বা অন্য কোনো পক্ষকে দেওয়া হয়। এছাড়া অবৈধ অর্থের একটি অংশ আসামিরা নিজেদের ভোগ বিলাসে ব্যয় করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান সোমবার তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, বিগো এবং লাইকির আড়ালে অর্থ পাচার মামলার তদন্ত শেষ। চার্জশিট প্রায় চূড়ান্ত। যে কোনোদিন তা আদালতে জমা দেওয়া হতে পারে। আসামি হিসাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলাটি শতভাগ পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কারও রাজনৈতিক বা অন্য কোনো পরিচয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।