দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮৭ আসনে জাতীয় পার্টি ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় জায়গা পাননি দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের অনুসারীদের কেউ। বাদ পড়াদের মধ্যে চারজন সংসদ সদস্য যেমন আছেন, তেমনি রওশনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নেতারাও বিবেচনায় আসেননি। এরশাদপুত্র রাহগির আল মাহি সাদের আসনে প্রার্থী হয়েছেন খোদ জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এ অবস্থায় দলের ভেতরে চলমান কোন্দল নিরসন না হলে নির্বাচন না করার বিষয়ে অনড় অবস্থান নিয়েছেন বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন।
গত সোমবার জাতীয় পার্টি ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় নাম নেই বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, তার ছেলে রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও দলের সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, বর্তমান সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজি, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন রাজুসহ আলোচিত বেশ কয়েকজন নেতা।
জানা গেছে, দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরই রওশনপন্থিরা জরুরি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে গোলাম মসিহ আবারও জানিয়েছেন, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে যাবেন না রওশন। তার নামে মনোনয়ন ফরম রাখা হলেও দলীয় কার্যালয় থেকে তা এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন দাখিলের শেষ সময়।
জাপার একাধিক কো-চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধানে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। আজ বুধবারের মধ্যে তা দৃশ্যমান হতে পারে। দুপক্ষ একমত হলেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, দলীয় কোন্দল নিরসনে জি এম কাদেরকে কয়েকটি শর্ত দিয়েছিলেন রওশন। এর মধ্যে এক নম্বরটি হলো— তাকে কেন্দ্র করে দলের কার্যক্রম পরিচালনা। এ ছাড়া সবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং ১৩টি আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে বলেছিলেন রওশন। কিন্তু জি এম কাদের তিনটির বেশি আসন দিতে রাজি হননি। রওশন এরশাদ এতে সম্মত না হওয়ায় আর সমঝোতা হয়নি। এরপর রওশন এরশাদের আসন ফাঁকা রেখেই দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি। ওই তালিকায় ছেলে সাদসহ অন্যদের নাম না দেখে রওশন হতাশ হন। এর পরই তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহর মাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জাপার অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন না হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না।
এ বিষয়ে গোলাম মসিহ বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ সোমবার বিকেল ৪টায় আমাকে বলেছিলেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সন্ধ্যায় দেখলাম জি এম কাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছেন। এমন বাস্তবতায় বিরোধী দলের নেতা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এককথায় নির্বাচন থেকে তাকে মাইনাস করা হয়েছে।’
অন্যদিকে, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গার রংপুর-১ আসনে এরশাদ ও জি এম কাদেরের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাঙ্গা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জাতীয় পার্টিকে ‘পরগাছা’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তবে ভেতরে ভেতরে নিজের আসন ফিরে পেতে রওশনপন্থি এই নেতা দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
রওশনের অনুসারীরা বলছেন, সংকট সমাধানের আশায় বিরোধীদলীয় নেতা আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দেননি। কিন্তু দলের বর্তমান নেতারা তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ বলেন, ‘আমরা, অর্থাৎ রওশন এরশাদ দলটিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, সবাই এক হয়ে নির্বাচন করবে। কিন্তু আমাদের দলের মনোনয়নের আবেদন ফরম পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এবার জি এম কাদের নিজেই দলে ভাঙনের পথ করে দিলেন।’
জাপার কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে সংকট কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমরা আশাবাদী, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েও পাননি। এতে তিনি আরও হতাশ হয়ে পড়েন। এর পরই সোমবার রাতে তার অনুসারী নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না। মূলত দলের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন রওশন।
জাতীয় পার্টির কোনো কোনো নেতার মতে, রাজনীতির খেলায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে হেরে গেছেন রওশন এরশাদ। আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে কার্যত মাইনাস হয়ে গেছেন তিনি। এরপর জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদটিও হারাতে পারেন।
এ বিষয়ে গোলাম মসিহ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চাওয়া হয়েছিল, তিনি এখনো সময় দেননি। রওশন এরশাদ সেই অপেক্ষায় আছেন। আমার কাছে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যদি ম্যাডামকে ডাকেন, তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
এদিকে সার্বিক বিষয়ে গতকাল বিকেলে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের গুলশানের বাসায় জাপা নেতাদের একটি বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বাসায় দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা সেখানে খাওয়া-দাওয়া করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দলে কোনো বিভেদ বা সংকট নেই। আমরা কোনো সংকট দেখি না, আপনারা কেন দেখেন। সংকট আছে মনোনয়ন নিয়ে। প্রায় ১ হাজার ৮০০ প্রার্থী মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। পেয়েছেন মাত্র ৩০০ জন। এজন্য অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।’