রাজনীতির ময়দানে আলোচিত এক চরিত্র ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সরকারদলীয় নেতা থেকে শুরু করে আন্দোলনরত বিভিন্ন দল সম্পর্কে প্রায়ই নানা মন্তব্য করেন তিনি। কখনো পক্ষে বলেন, কখনো বিপক্ষে।
কোনো একটি বিষয়ে সময়ে সময়ে অবস্থান বদলের কারণে রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচিত নুর। বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগকে চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, চিটার-বাটপারের দল বলেও মন্তব্য করেন। আবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মা’ বলেও ডাকেন।
তিনিই খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেন। আবার তারেক রহমানেরও তীব্র সমালোচনা করেন। এমন বহুমুখী আচরণের কারণে নুরের রাজনৈতিক তৎপরতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের মনোভাব ও পদক্ষেপের কারণেই তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গোলকধাঁধা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নুরের সাক্ষাতের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিটি প্রকাশ হওয়ার পর নুরের দলের নেতাকর্মীরা এটিকে ভুয়া ও এডিটেড বলে মন্তব্য করেন। যদিও নুর নিজে এ ধরনের বৈঠককে অন্যায় মনে করেন না বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন।
এমন বৈঠকের সুযোগ পেলে লুফে নিতেন বলে এক ভিডিওতে তিনি বলেন। বিদেশ সফরে সাফাদির সঙ্গে ‘ওই বৈঠকের’ পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, দেশে ফিরলেই নুর আইনি জটিলতায় পড়বেন। কিন্তু তেমন কিছু তো হয়ইনি, উল্টো তার দলের নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
সরকারের সমালোচনা বা কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে গত এক দশকে বিভিন্ন দলের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো নেতা বাদ যাননি। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নুর। বিভিন্ন সময়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেও একবারের জন্যও জেলে যেতে হয়নি তাকে। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার পরও গ্রেপ্তার হননি তিনি।
মোসাদের এজেন্টের সঙ্গে ওই বৈঠকের প্রেক্ষাপটে গত ৯ জানুয়ারি বৈধ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সিলেটে নুরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়। তবে ৯ দিন পরও এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।
এর আগে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা তার নামে মামলা করলেও গ্রেপ্তার হননি নুর। তাকে গ্রেপ্তার না করার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। তার ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও স্পষ্ট নয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্থান নুরুল হক নুরের। ওই সময়ে এই প্ল্যাটফর্মের নেতা হাসান আল মামুন জনসমক্ষে ভালো বক্তব্য রাখতে পারতেন না। এই সংকটে রাশেদ খানকে সামনে আনা হলেও তার বিরুদ্ধে শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠায় পরবর্তী সময়ে নুরকে সামনে নিয়ে আসা হয়।
কারণ, তিনি হাজী মুহাম্মদ মহসীন হল ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতা। তাকে আনলে এই আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। কোটা সংস্কার প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য ছিল কোটা সংস্কারের পর সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু নুর ও তার সংগঠনের বেশ কয়েকজন এটিকে রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তর করেন।
এই সংগঠনের হাত দিয়েই নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘ ২৭ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের সহসভাপতি (ভিপি) পদে নুরের জয়ে বেশ কৌতুহল হয়েছিল ঢাবির শিক্ষার্থীসহ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। কারণ, এ পদে নির্বাচন করেছিল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভন।
ওই সময় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী ডাকসুর জিএস পদে এবং ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এজিএস পদে পাস করলেও শোভন ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়ে ডাকসুর পুরো প্যানেল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গবভনে গেলেও পৃথকভাবে উবার ডেকে বঙ্গভবনে উপস্থিত হন নুর।
তিনি সেখানে বক্তব্যের ফাঁকে আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং প্রধানমন্ত্রীকে মা বলে সম্বোধন করেন। এ সময় প্রধানন্ত্রীকে মা বলে সম্বোধন করা ও ছাত্রলীগের সঙ্গে বঙ্গভবনে না যাওয়া—ভিপি নুরের এমন দ্বিমুখী আচরণে বেশ অবাক হয়েছিলেন তার দলের নেতাকর্মীরাও।
ভিপি নুরকে নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ভিপি হওয়ার পর তাকে শিক্ষার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি। যদিও ছাত্রলীগ তাকে কাজ করতে দেয়নি বলে অভিযোগ করে থাকেন। কাজ না করলেও নিয়মিত সরকারের বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন মন্তব্যের মাধ্যমে বেশ সরব ছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে মামলা হলেও গ্রেপ্তার না করাকে সরকারের চালাকি মনে করেন নুরুল হক নুর। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘অনেককে গ্রেপ্তার না করে সরকার মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে এক ধরনের সন্দেহ ছড়িয়ে দেয়। দেখাতে চায়, অমুকও তো এভাবে কথা বলে, তাকে তো সরকার গ্রেপ্তার করছে না। তার সঙ্গে বোধহয় সরকারের লিয়াজোঁ রয়েছে। বিভিন্ন বিষয় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়।’
তার মতে, ‘সরকার যদি সব বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে একসঙ্গে গ্রেপ্তার করে, তাহলে তো বিদেশিদের কাছে দেখাতে পারবে না যে, দেশে গণতন্ত্র আছে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেজন্য সরকার কিছু কিছু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে, আবার অনেককে করে না।’
গণঅধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পর ভিপি নুর সরকার, সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নামে ঢালাওভাবে সমালোচনা করেছেন। বরাবরই তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বিরোধী কথা বলে জনসাধারণের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এ কাজে সরকারবিরোধী দলের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
ভিপি নুর বিভিন্ন সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছেন, আবার তারেক রহমানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিএনপি যখন জোরালো আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে, তখনই সরব হতে দেখা গেছে ভিপি নুরকে। এ সময় সরকার ও বিরোধী দলের একটি মহল ভিপি নুরের বক্তব্য নিয়ে বেশ সরব থাকতেও দেখা গেছে। আবার এও দেখা গেছে, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির পক্ষেও কথা বলেছেন।
হামলা-মামলা সরকারি দলের কর্মীদের মধ্যে ভিপি নুরকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও সরকারের মধ্যে তা দৃশ্যমান নয়। এ কারণে সরকারের সমালোচনার পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।
তার ওপর যতবার হামলা হয়েছে, ততবারই তিনি রাজনৈতিক আলোচনার শীর্ষে এসেছেন এবং দেশের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত তার ওপর ২৩ বার হামলা হয়েছে। আর মামলা হয়েছে অন্তত ১৩টি। তবে কোনো মামলায় এখন পর্যন্ত তাকে জেলে যেতে হয়নি। কয়েকবার গোয়েন্দা কার্যালয়ে গেলেও তাকে গ্রেপ্তার না করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকাবিরোধী গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও মঞ্চের সঙ্গে তার দল গণঅধিকার পরিষদের টানাপোড়েন এখন চরমে। গুঞ্জন রয়েছে, যে কোনো সময় গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে পারেন। এমনকি নিজের দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গেও তার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি প্রেস ক্লাবের সামনে পূর্বনির্ধারিত সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সমাবেশ করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এই সমাবেশে অংশ নেয়নি নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ।