রাজধানীর নয়াপল্টনেই গণসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। তবে হঠাৎ এই সমাবেশের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম প্রস্তাব করে সেখানে ছাত্রলীগের পূর্বনির্ধারিত সম্মেলন বিএনপির জন্য দুই দিন এগিয়ে আনা এবং মঞ্চ গুটিয়ে নেওয়ার আশ্বাস ‘কৌতূহল’ সৃষ্টি করেছে দলে।
এটা সরকারের উদারতা নাকি নতুন কোনো ‘ফাঁদ’, তা নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এসবের মধ্যেই ঢাকার সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশের সর্বশেষ কর্মসূচি হবে ঢাকায়, আগামী ১০ ডিসেম্বর। এই দিন ঢাকায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে ১৩ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে লিখিত আবেদন করে বিএনপি।
এ সমাবেশ নিয়ে নানা বিতর্কের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিএনপি কিছু শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি পাবে। যদিও বিএনপির আবেদনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল না বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, প্রথম দিকে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীরা কড়া ভাষায় বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেখানে হঠাৎ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিতে সরকার এত নমনীয়তা দেখাচ্ছে কেন?
এর কারণ হিসেবে দলের নেতারা বলছেন, বিএনপি এ পর্যন্ত আটটি বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছে। এর মধ্যে কেবল কুমিল্লা ছাড়া আর কোথাও বিনা বাধায় সমাবেশ করতে পারেনি। এমনকি আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে যে গণসমাবেশ, সেটি ঘিরে এরই মধ্যে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।
একই সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সেখানে নতুন নতুন ‘গায়েবি’ মামলাও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য ছাত্রলীগের সম্মেলন দুই দিন এগিয়ে এনে আওয়ামী লীগের হঠাৎ এমন উদারতার পেছনে কোনো ‘ফন্দি’ থাকতে পারে।
অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতির বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর দলটির কোনো কোনো নেতা এই বলে আপত্তি তোলেন যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮ ও ৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে। তাহলে পরদিনই সেখানে তাঁরা কীভাবে মঞ্চ বানাবেন, সমাবেশ করবেন। এর রেশ ধরে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি যেন ঢাকায় সুষ্ঠুভাবে সমাবেশ করতে পারে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের সম্মেলন ৬ ডিসেম্বর করা হয়েছে। বিএনপি অজুহাত দেখাচ্ছে, ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন, কী করে তারা ১০ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করবে। সে জন্য ছাত্রলীগের সম্মেলন ৬ তারিখে আনা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, নয়টি বিভাগীয় সমাবেশ শেষে বিএনপি ঢাকায় বড় জমায়েত করবে। নয়াপল্টনে সমাবেশ হলে জনদুর্ভোগ বাড়বে, পুরো ঢাকার গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এ যুক্তিতে তারা বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করাতে সরকারি দলের উৎসাহের বিষয়টি নিয়ে গতকাল সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়। দলটির নেতারা মনে করেন, সরকার কোনো অজানা ‘ভয়’ বা ‘আতঙ্ক’ থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকিয়ে সমাবেশ করাতে চাইছে।
এর পেছনে একটা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিও রয়েছে। বিএনপিকে দেয়ালবেষ্টিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবদ্ধ রেখে নিজেদের নিরাপদ রাখা, একই সঙ্গে নয়াপল্টন এলাকায় বড় গণজমায়েতের যে রাজনৈতিক প্রভাব, সেখান থেকে বঞ্চিত করার কৌশল রয়েছে আওয়ামী লীগের।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অভিমত হচ্ছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আগের মতো খোলামেলা নেই। চারদিকে দেয়ালবেষ্টিত উদ্যানে প্রচুর গাছপালা। বসার জায়গাও তুলনামূলকভাবে কম। উদ্যানে ঢোকার ফটকগুলো ছোট। ফলে বড় আকারের সমাবেশে নেতা-কর্মীদের ঢুকতে এবং বের হতে বেশ কষ্ট হয়।
তা ছাড়া বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল ফটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকেন। অতীতে সেখানে সমাবেশ শেষে বের হয়ে ফেরার পথে অনেক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া সমাবেশ ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ছাত্রলীগের হামলার আশঙ্কাও করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
যদিও গতকাল দিনাজপুরে দলীয় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে বিএনপিকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বিএনপির সমাবেশ নিয়ে বলেছেন, ছাত্রলীগকে ভয় পাবেন না। শেখ হাসিনার নির্দেশে একজন ছাত্রলীগ কর্মীও সমাবেশের আশপাশে যাবে না।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা মনে করি না সরকার কোনো সুস্থ চিন্তায় আছে। তারা যা বলে, করে তার উল্টোটা। বিএনপি এ পর্যন্ত আটটি সমাবেশ করেছে। কুমিল্লা ছাড়া সবখানে পরিবহন ধর্মঘট দিয়ে সরকারি দলই তো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। সেখানে ঢাকায় এক দিনের সমাবেশের জন্য জনদুর্ভোগের প্রশ্ন আসে কেন?’