নাম নেই ঠিকানা নেই তাই মর্গের খাতায় লেখা ‘অজ্ঞাত’
লাশ কাটা ঘরে পড়ে ছিল লাশটি। নাম নেই, ঠিকানা নেই, তাই মর্গের খাতায় তখনো লেখা ‘অজ্ঞাত’। পুলিশের কাগজপত্রেও তা-ই। অথচ মৃত্যুর আগেও তার পরিচয় ছিল। তিনি কারও বোন, মা বা অন্য কোনো স্বজন। পরিবারের লোকজন হয়তো তার অপেক্ষায় বসে আছেন কিংবা ছিলেন।
রাজধানীর ধানমন্ডির সোবহানবাগে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর বিকালে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হন অজ্ঞাত এক নারী। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সেই অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা দ্রুতই তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উদঘাটন করেন। এই নারীর নাম সুফিয়া বেগম (৫৫)। বাড়ি কিশোরগঞ্জের হেমন্তগঞ্জের মিঠাইমনা গ্রামে। পরিবারের কাছে বেশ কিছুদিন নিখোঁজ ছিলেন তিনি।পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের তথ্যানুযায়ী, অজ্ঞাত লাশের প্রায় ৭০ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
তবে যাদের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে এদের ৬০-৭০ শতাংশই থাকেন বিভিন্ন এলাকায় নিখোঁজ।সংস্থাটির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, উদ্ধার হওয়া লাশের বেশির ভাগই সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ভবঘুরে কিংবা ছিন্নমূল মানুষ। এরা অনেকেই মানসিক সমস্যাগ্রস্ত হওয়ায় পরিবারের কাছে দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকেন। আর তারা অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর সেগুলো শনাক্তের জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এফআইভিইএস) ব্যবহার করে থাকেন।
লাশ শনাক্তের এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় একটি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। পিবিআই সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের এফআইভিইএস শাখায় কর্মরত সার্জেন্ট নাভিদ ইমতিয়াজ এ প্রতিবেদককে জানান, লাশ শনাক্ত করার পদ্ধতি নিয়ে পিবিআই কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালে এসে তারা পুরো ব্যবস্থাটি দাঁড় করায়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে কাজ শুরু করে।
যাদের এনআইডি নেই এবং যাদের বয়স ১৮ বছরের কম, এই প্রযুক্তিতে তাদের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব নয়। যেসব অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যায় তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই ভবঘুরে, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি। পরিবারের কাছ থেকে এরা দীর্ঘদিন নিখোঁজ অবস্থায় থাকেন। পরে লাশ শনাক্ত হলে যে পরিবার স্বজনের লাশটি ঠিকমতো দাফন করার সুযোগ পান এতে আমরা খুশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর ১২ অক্টোবর ময়মনসিংহের কোতোয়ালিতে সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। পরে ময়মনসিংহ পিবিআইর এসআই লোকমান হোসেন ওই ব্যক্তির ফিঙ্গার প্রিন্টের ছাপ নিয়ে তার পরিচয় শনাক্ত করেন। এরপর জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম ইলিয়াস ভূঁইয়া।
তার বাড়ি নরসিংদীর সদর উপজেলার আমলিয়া ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। ইলিয়াস মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। লাশের খোঁজ পাওয়ার পর ইলিয়াসের স্বজনরা পুলিশকে জানান, ইলিয়াস প্রতিবন্ধী কার্ডধারী ছিলেন। এক থেকে দেড় বছর আগে তিনি বাড়ি থেকে চলে যান। পরে তাকে কিশোরগঞ্জ থেকে পাওয়া যায়। আর ময়মনসিংহে লাশ উদ্ধারের ঘটনার প্রায় ছয় মাস আগে তিনি ফের নিখোঁজ হয়ে যান।
গত বছর ১০ অক্টোবর ময়মনসিংহে রেললাইনে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। মামলা নম্বর-২৩। লাশটি পাওয়ার পরই ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করেন জেলা পিবিআইর কর্মকর্তারা। পিবিআইর এসআই পংকজ কুমার আচার্য্য ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ওই নারীর পরিচয় শনাক্ত করেন। তার নাম সখিনা বেগম।
তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই নারীও ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামে। ঘটনার সাত-আট বছর আগে তিনি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। চলতি বছর ৭ অক্টোবর সিলেটের সদর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তার বয়স আনুমানিক ৫২।
পরে জানা যায়, এই ব্যক্তির নাম আহাম্মদ আলী। বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুরের হাবিবপুর গ্রামে। তিনিও মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিলেন। একই জেলায় ২৮ আগস্ট অজ্ঞাত আরেকটি লাশ পাওয়া যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় এই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই ব্যক্তি বাড়ি থেকে প্রায় এক বছর নিখোঁজ ছিলেন। তার নাম মোস্তফা মিয়া। বাড়ি নরসিংদীর রায়পুর উপজেলার আমীরগঞ্জে।
এদিকে ২০২১ সালের শুরুতে শেরপুরের শ্রীবরদী থানায় একটি নিখোঁজের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। এর বছরখানেক পরে ভুক্তভোগী জহুরা বেগমকে (৪৮) পাওয়া যায়। চলতি বছর অক্টোবরের শুরুতে ফের হারিয়ে যান তিনি। সড়ক দুর্ঘটনার পর ১৫ অক্টোবর যশোর কোতোয়ালিতে অজ্ঞাত হিসেবে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় জেলা পিবিআইতে একটি জিডি হয়। জিডি নম্বর-১৫৯। পরে পিবিআইর কর্মকর্তারা শ্রীবরদীর ভেলুয়া গ্রামে ওই নারীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই নারীর স্বজনরা এতটাই দরিদ্র যে, যশোর থেকে লাশ নিয়ে গিয়ে দাফন করার মতোও তাদের সামর্থ্য ছিল না। পরে তাদের ব্যবস্থাপনায় লাশটির দাফন সম্পন্ন হয়।
পিবিআইর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা পুরোপুরি না পারলেও অজ্ঞাত লাশের ২৮ শতাংশ শনাক্ত করতে পেরে অনেকটা আনন্দিত। এ ছাড়া এর মাধ্যমে আমরা বহু মামলা ডিটেক্ট করতে পেরেছি। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকে মারা গেছেন, পরিবার লাশ পাচ্ছে না।
কিংবা অনেক নিখোঁজকেও পরিবার পাচ্ছে না। আমরা তাদের কাছে প্রযুক্তির সহায়তায় লাশটি ফিরিয়ে দিতে পেরে খুশি।’ এদিকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর- এই পাঁচ বছরে ৬ হাজার ২১৩ জনকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে তারা। অর্থাৎ প্রতিবছর ১ হাজার জনের বেশি মানুষকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। আর ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত দাফন করেছে ১ হাজার ৪৫৩টি লাশ।
পিবিআইর হিসাবে গত তিন বছরে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশের ৭৭ দশমিক ৭৯ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে চলতি বছর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ৮১৯টি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে কাজ করেছে পিবিআই। এর মধ্যে পরিচয় শনাক্ত হয়েছে ৬২৬টি লাশের, যাদের মধ্যে পুরুষ ৪৫৯ ও নারী ১৬৭ জন। শনাক্তের হার ২২ দশমিক ২১ শতাংশ।