বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গোলাগুলি চলছে। রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে এক রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এতে এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই কিশোরের মৃত্যু হয়।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রায় মাসখানেক ধরে চলছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ ও গোলাগুলি। এতে প্রায়ই বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়ছে মিয়ানমারের মর্টারশেল ও গোলা। সবশেষ গতকাল তুমব্রু সীমান্তে পাওয়া গেছে দেশটির ছোড়া একে-৪৭ এর গুলি। এমন পরিস্থিাতিতে মৃত্যু আতঙ্কে দিন পার করছেন সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা।
তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা ও ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে ছয়জন রোহিঙ্গা আহত হন। পরে ইকবাল নামে এক রোহিঙ্গা তরুণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
এক শিশুসহ আহত পাঁচ রোহিঙ্গা বর্তমানে এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত ব্যক্তিরা একই পরিবারের সদস্য কিংবা আত্মীয় কিনা তা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।তবে প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
মারা যাওয়া কিশোরের নাম মো. ইকবাল (১৫)। সে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা মুনির আহমদের ছেলে। আহত ব্যক্তিরা হলেন সাহদিয়া (৪), মো. আনাস (১৫), নবী হোসেন (২১), জাহিদ আলম (৩০) ও আহত অপর একজনের নাম জানা যায়নি।
স্থাানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় মাসখানেক ধরে ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাইশ ফাঁড়ি বিওপির সীমান্ত পিলার ৩৬-এর বিপরীতে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের মেধাইক ক্যাম্প এলাকায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ ও গোলাগুলি চলছে। সংঘর্ষ ও গোলাগুলির কারণে প্রতিদিন আনুমানিক ৪০০-৫০০ রাউন্ড গুলির শব্দ ও ২০-২৫টি মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আবার মুহুর্মুহু গোলাগুলি শব্দ শোনা যায়। প্রায় তিন দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকার পর আবার গোলাগুলি শুরু হয়েছে। মর্টার শেলের গোলার বিকট শব্দে কাঁপছে এপারের ভূখণ্ড। এতে এপারের ঘুমধুম ইউনিয়নের ২০ গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাত ১০টা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পাঁচ বছর ধরে আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে বসবাস করছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবির ঘেঁষে (পেছনে) মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড়। পাহাড়ের ওপর দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক তল্লাশিচৌকি।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে মিয়ানমারের পাহাড় থেকে মুহুর্মুহ গুলিবর্ষণের পাশাপাশি থেমে থেমে মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছিল। বেশ কিছু গুলি ও মর্টার শেল শূন্যরেথার বিভিন্ন জায়গায় এসে পড়ছিল।
রাত আটটা ২০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে একটি মর্টার শেল আশ্রয়শিবিরের ওপর এসে পড়ে। এত ছয়জন রোহিঙ্গা আহত হন। পরে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ও পরে মিয়ানমারের একটি জেট ফাইটার বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে তুমব্রু এলাকা চক্কর দিয়ে রাখাইন রাজ্যের দিকে ফিরে গেছে।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, তিন দিন ধরে আশ্রয়শিবিরের পেছনের পাহাড়ে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে পাহাড়ের চৌকি থেকে ব্যাপক হারে গুলি ছোড়ার পাশাপাশি মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। গোলাগুলি চলছে। কিন্তু কী কারণে এত বেশি গোলা ও মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না।
ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু এলাকার কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী কোন সময় গুলি ছোড়ে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। তারা গুলি ছুড়লে জবাবদিহি করতে হয় না। তিন দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকায় ঘুমধুমের বেশ কিছু কৃষক চাষাবাদে মাঠে নামলেও আগামীকাল থেকে কারও নামা হবে না। সীমান্তে মাইন আতঙ্কে ভুগছেন চাষিরা।
রোহিঙ্গা নেতাদের ধারণা, তিন দিন এই সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধ রেখে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে মিয়ানমার। ঘুমধুম ২ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু এলাকার ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ গোলাগুলির বিকট শব্দে তুমব্রুর ভূখণ্ড কাঁপছে। এতে এলাকার মানুষ ফের আতঙ্কে আছেন।
এক মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। তাঁরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। চাষিরা মাঠে নামতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা পাঠের পরিবেশ হারাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও কেন্দ্রে যেতে নিরাপদ বোধ করছে না। সীমান্তের ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষার্থী আছে ৪৯৯ জন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ১৩ আগস্ট থেকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) যুদ্ধ চলছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধ বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
উল্টো ২৭১ কিলোমিটার স্থল ও জলসীমানায় তৎপরতা বাড়াচ্ছে মিয়ানমার। তিন দিন ধরে সেন্ট মার্টিনের বিপরীতে (পূর্ব দিকে) মিয়ানমার জলসীমানায় দেশটির তিনটি নৌবাহিনীর জাহাজ তৎপরতা শুরু করে। তবে সেন্ট মার্টিন জলসীমানাতেও তৎপর আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।
বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে