অপরাধআইন-আদালতখুনচট্টগ্রামবাংলাদেশ

ক্যারিয়ার নষ্টের আশঙ্কায় মিতুকে খুন করেছেন তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার

বিতর্কের মধ্যেই চট্টগ্রামে আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার চার্জশিট দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এতে দাবি করা হয়েছে, ‘পরকীয়ার জেরে পারিবারিক অশান্তি আর তার জেরে ক্যারিয়ার নষ্টের আশঙ্কায়’ মিতুকে খুন করেছেন তাঁর স্বামী তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার।

চার্জশিটে বাবুলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তবে তিনি খুনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং সম্প্রতি পিবিআইপ্রধানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন।চার্জশিটে বাবুলসহ সাত আসামিকে অভিযুক্ত এবং পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটভুক্ত দুই আসামিকে পলাতক দেখানো হয়েছে। তবে এ খুনের খলনায়ক কামরুল ইসলাম মুছার কোনো হদিস পায়নি বলে দাবি করেছে পিবিআই।

হত্যাকাণ্ডের সাত বছরের বেশি সময় পর মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেট্রেপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পুলিশ প্রসিকিউশনে ২০ পৃষ্ঠার চার্জশিট দাখিল করেন পিবিআই ইন্সপেক্টর আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক। লাগেজভর্তি করে দুই হাজার ৮০ পৃষ্ঠার মামলার কেস ডকেট চার্জশিটের সঙ্গে জমা দিয়েছে পিবিআই।

চার্জশিটে বলা হয়েছে, ‘বাবুল আক্তার পরকীয়ার বিষয়টি তাঁর স্ত্রী এক সময় জেনে যান। তার পর তাঁদের পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। বাবুল আক্তার তখন তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ তাঁর পরকীয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে চাকরি জীবনে প্রত্যাশিত উন্নতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করতে শুরু করেন।

পরকীয়ার কারণে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ তথা ডিভোর্স হয়ে গেলে চাকরিতে তাঁর ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ না হওয়ার ভয় ছিল। তাই ক্যারিয়ার ঠিক রাখতেই স্ত্রীকে খুন করেন বাবুল আক্তার।’এতে আরও বলা হয়, স্ত্রীকে খুন করার জন্য মুছার সঙ্গে তিন লাখ টাকার চুক্তি করেন বাবুল। বাবুল তাঁর কথিত ব্যবসায়িক অংশীদারের মাধ্যমে বিকাশে মুছাকে টাকা দিয়েছেন।

চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- বাবুল আক্তার, মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম মুছা ও খায়রুল ইসলাম। এর মধ্যে মুছা ও খায়রুল পলাতক। চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে- আবু নসর, শাহজামান, সাইদুল ইসলাম শিকদার, নুর নবী ও রাশেদুল ইসলামকে। এর মধ্যে নুর নবী ও রাশেদুল পুলিশের সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছেন।

পিবিআইর পুলিশ সুপার (মেট্রো) কাজী নাইমা হাসান বলেন, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে মামলাটি তদন্ত করেছে পিবিআই। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদন্তভার পাওয়ার পর আড়াই বছরে তদন্ত চলাকালে মিতু খুনে জড়িতদের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম বলেন, আগামী ১০ অক্টোবর মিতু খুনের মামলার পরবর্তী শুনানিতে চার্জশিট গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

ডিবির কাছে দীর্ঘদিন তদন্তভার থাকলেও স্থবির হয়ে ছিল মামলার তদন্ত। তখনই মামলার আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। শুনানিতে নথি তলব করেন হাইকোর্ট। তখন নথি পর্যালোচনা করে দেখেন, মামলার তদন্তে নানা অসংগতি। তার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর সন্তোষ কুমার চাকমাকে তলব করেন হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে গতি বাড়ে মামলার তদন্তের।

একপর্যায়ে মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল বাবুল আক্তার।

বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। এর জের ধরে বাবুলকে পরিকল্পিতভাবে লোক ভাড়া করে মিতুকে খুন করে। তবে মিতু হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, তাদের মধ্যে কোনো দাম্পত্য কলহ ছিল না।

পিবিআইর চার্জশিটে বলা হয়, মামলার আলামত হিসেবে উপহার পাওয়া বাবুল আক্তারের একটি বই জব্দের পর হত্যাকাে র জট খোলে। ২০১৩ সালে কক্সবাজার জেলা পুলিশে কর্মরত থাকার সময় বাবুলের সঙ্গে সেখানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত গায়ত্রী সিংয়ের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

গায়ত্রী বাবুলকে আহমেদ রশিদ রচিত ইংরেজি ভাষার ‘তালিবান’ নামে একটি বই উপহার দেন। ওই বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রী অমর সিংয়ের নিজের হাতের লেখা এবং শেষ পাতা ২৭৬ এর পরের খালি পাতাটিতে বাবুল আক্তারের হাতে লেখা ইংরেজিতে তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের বিষয়সহ কিছু তথ্য লেখা আছে। পরে সিআইডির হস্তবিশারদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বইয়ের পাতায় লেখাগুলো বাবুল আক্তারেরই।

২০১৬ সালের ৫ জুন নগরীর জিইসি মোড়ে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মিতুকে। স্ত্রী খুনের ঘটনায় পুলিশ সদরদপ্তরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় ২০২১ সালের মে মাসে আসামি করা হয় বাবুলকে।

তিনি এখন ফেনী কারাগারে বন্দি। সম্প্রতি তিনি পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে নালিশি মামলা করেছেন। পিবিআইর তদন্তের স্বচ্ছতা নিয়ে বাবুলের পরিবারসহ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

বাংলা ম্যাগাজিন এস/কে  

Back to top button