ভিডিও কলের প্রতিটি মুহূর্তের অন্তরঙ্গ ছবি রেকর্ড করে নতুন ফাঁদ
প্রেমের সম্পর্কের কারণে তরুণী প্রেমিকের অনেক আবদারই মেটানোর চেষ্টা করতেন। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগান প্রেমিক আজিম। তরুণীকে নগ্নভাবে ভিডিও কলে আসার প্রস্তাব করেন আজিম। প্রথম দিকে রাজি না হলেও পরে প্রেমিকের জোরালো আবদারে রাজি হন। বিয়ের আশ্বাস ও প্রেমিককে বিশ্বাস করেই একাধিকবার নগ্নভাবে ভিডিও কলে আসেন।
প্রেমিকা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটতো। এরই মধ্যে ফেসবুকে পরিচয় হয় মো. আজিম নামের এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয়ের পর ফেসবুক মেসেঞ্জারে তারা চ্যাটিং ও অডিও কলে কথা বলতেন।
নিয়মিত কথা বলতে বলতে দু’জন দু’জনের প্রতি দুর্বল হয়ে যান। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য বাড়ে এবং সেটি প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। কিছুদিন যেতে না যেতে গভীর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। অডিও কল ছেড়ে তারা রাতদিন মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে ভিডিও কলে কথা বলতেন।
সময় যত গড়াচ্ছিল দু’জনের সম্পর্ক আরও মধুর হচ্ছিল। কিন্তু তরুণী জানতেন না তার কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছে। প্রেমিক আজিম ভিডিও কলের প্রতিটি মুহূর্তের নগ্ন ছবি ও স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে ভিডিও ধারণ করে নিজের কাছে রেখে দেন। অন্ধ বিশ্বাসের কারণে যা একটুও টের পাননি তরুণী।
চতুর আজিম বেশিদিন ভিডিও কলে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তৈরি করেন নতুন ফাঁদ। তরুণীকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। রাজি হননি তরুণী। অনেক কাকুতি-মিনতি করেন আজিম। তবুও তরুণী তার সিদ্ধান্তে অটল।
পরে আজিম তার সংরক্ষণে থাকা সকল নগ্ন স্থিরচিত্র ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিতে থাকেন। বিশ্বাস হয়নি তরুণীর। যাকে এত ভালোবাসেন সে তার সঙ্গে এত বড় ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না। যদিও তার ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি।
আজিম তার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে তরুণীর হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি ও ভিডিও পাঠান। এসব দেখে আকাশ ভেঙে পড়ে তরুণীর। সংরক্ষণে থাকা সব ছবি ভিডিওডিলেট করার অনুরোধ করেন প্রেমিককে। ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকের কুপ্রস্তাবে সাড়া দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করেন। ভেবেছিলেন শারীরিক সম্পর্ক করলে প্রেমিকের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
সম্পর্ক চলাকালীন আজিম তাদের মধ্যে ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ কথা বলার মুহূর্ত গোপনে ধারণ করে রাখে। পরে সেগুলো তার মেয়ের মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা নেয়। পরে আরও টাকা দাবি করে আজিম তার বাসায় গিয়ে একান্ত সময় কাটানোর প্রস্তাব দেয়।
টাকা না দিলে আর বাসায় গিয়ে সময় না কাটালে ভিডিও ও ছবি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবীদের কাছেও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। রাজি না হওয়াতে আজিম তার মেয়ের বান্ধবীদের কাছে ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে দেয়। পরে মেয়ের বান্ধবীরা তাকে এসব বিষয় জানায়।
শারীরিক সম্পর্ক চলাকালীন সময়ের মূহূর্তও গোপনে মোবাইল ফোনে ধারণ করেন। সেটিও টের পাননি তরুণী। আবার একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করেও আজিমের মোবাইল ফোন থেকে ভিডিও ডিলেট করাতে পারেননি। ভুক্তভোগী তরুণী উপায়ান্তর না পেয়ে সম্পর্কের ইতি টানেন।
শারীরিক সম্পর্ক থেকেও দূরে সরে আসেন। এমন অবস্থায় আজিম ক্ষেপে যান। পরে শারীরিক সম্পর্ক চলাকালীন ধারণ করা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মোবাইল ফোনে পাঠানোর হুমকি দিয়ে টাকা চান। নিরুপায় তরুণী আরও অসহায় হয়ে পড়েন।
নিজের একাধিক নগ্ন ছবি, ভিডিও ও শারীরিক সম্পর্কের রেকর্ড থাকায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। নিজের এই মানসিক অবস্থার কথা কাউকে শেয়ারও করতে পারছিলেন না। তাই নিজে নিজেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্রেমিকের ব্ল্যাকমেইলের বিরুদ্ধে। ভয়ভীতি দেখিয়ে আজিম তরুণীর কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকেন।
এক সময় অপারগ মেয়েটি টাকা দিতে অসম্মতি জানান। তাই আজিম মেয়েটির নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে দেন প্রেমিকার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন, পরিবার ও বান্ধবীদের কাছে। পরে তারাই তরুণীকে বিষয়টি জানান। অল্প সময়ের ভেতরে সবার নজরে আসায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যান তরুণী।
উপায়ান্তর না পেয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নগ্ন স্থির চিত্র ও ভিডিও ধারণ এবং সেগুলো দেখিয়ে অর্থ আদায়, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে সরবরাহ করে সামাজিক মর্যাদাহানি ও ভয়ভীতি দেখানোর জন্য ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা দায়ের করেন।
ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলার পর মামলাটি তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার ক্রাইম ও স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশন। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পান গোয়েন্দারা। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গ্রেপ্তার করা হয় তরুণীর প্রেমিক সাতাশ বছর বয়সি আজিমকে।
এ সময় তার কাছ থেকে ১টি মোবাইল ফোন ও ২টি সিম উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার আজিমের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সিন্ধুরকাইট গ্রামে। সে ওই এলাকার মৃত ওজি উল্যা ও রওশন আরার ছেলে। তবে হাজারীবাগের জিগাতলার একটি বাসায় থাকত।
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মহিদুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে তাদের দুজনের সম্পর্ক শুরু হয়। আজিমের সাইবার ব্ল্যাকমেইলের কারণে তরুণীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। অন্ধ বিশ্বাসেই প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যায় তরুণী।
আর এই সুযোগটাই কাজে লাগায় আজিম। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোন থেকে তরুণীর অসংখ্য নগ্ন ছবি ও ভিডিও উদ্ধার করেছি। সে আমাদের কাছে তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছে।
তরুণীর বাবা মামলায় উল্লেখ করেছেন, ২৫ আগস্ট বিকালে তিনি তার মেয়ের মোবাইল ফোনে কিছু নগ্ন ছবি ও ভিডিও দেখতে পান। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, পূর্ব পরিচিত আজিম তার মোবাইল ফোনে এসব পাঠিয়েছে। পরে তিনি মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারেন, ২০২০ সাল থেকে তার মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে আজিমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
বাংলা ম্যাগাজিন এস/কে