রিকশাচালক রুস্তম থাকেন উত্তর বাড্ডা এলাকায়। মীরবাগ এলাকায় তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে আয় কমে গেছে। সংসারে খরচ বড়ে যাওয়ায় দিন দিন তার সংসারের ব্যয় বহন করা সীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়েই নিজের ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেকে কাজে পাঠিয়েছেন রুস্তম।
তিনি বলেন, ইচ্ছে ছিল আমার ছেলে পড়ালেখা করুক। কিন্তু বাসা ভাড়া ও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। সংসারে বাড়তি কিছু টাকা আয়ের জন্য ওয়ার্কশপে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। এ ছাড়া দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির পর শাকসবজিই এখন প্রধান খাবার হিসেবে দাঁড়িয়েছে আমাদের।
মুরগি বা গরুর মাংস খাওয়া অনেক আগেই বাদ। মাঝে মাঝে ডিম খেতাম। কিন্তু ডিমও এখন দামি খাবার হয়ে গেছে। রুস্তম বলেন, কাওরানবাজারে রাতে ট্রাকবোঝাই বিভিন্ন শাকসবজি আসে। এর মধ্যে ফেলে দেয়া পচা সবজির স্তূপ থেকে অনেকেই কিছু বেছে রাখে। পরে এসব সবজি কম দামে বিক্রি করে। এখান থেকে কম দামে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ও সবজি কিনি।
রিকশাচালক মাইদুল ইসলাম গাইবান্ধা থেকে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসেন ২০০৭ সালে। তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকার একটি গ্যারেজ থেকে ভাড়ায় রিকশা চালান। জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে রাজধানী ঢাকায় আগের মতো তেমন যাত্রী পাচ্ছেন না মাইদুল। কমেছে দৈনিক আয়ও।
আগে দৈনিক ৫০০-৮০০ টাকা আয় হলেও এখন তা অর্ধেকে ঠেকেছে। আগে মেস ভাড়া, খাওয়া খরচ বাদ দিয়ে গ্রামে পরিবারের জন্য টাকা পাঠানো যেতো। কিন্তু বর্তমানে পরিবারকে টাকা পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। মাইদুল বলেন, আসলে আমরাও তো বুঝি। মানুষের হাতে টাকা নাই। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ আগের মতো রিকশায় একদম জরুরি না হলে ওঠেন না।
হাঁটা পথ হলে হেঁটেই চলে যায়। সব মিলিয়ে আমাদেরও আয় কমে গেছে। তবে আমাদের সব জিনিস দ্বিগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বাড়িতে স্ত্রীসহ দুই ছেলেমেয়ে আছে। চিন্তা করছি তাদের ঢাকায় এনে বউকে গার্মেন্টে আর ছেলেকে গাড়ির গ্যারেজের ওয়ার্কশপে কাজ দেবো।
ছেলে পড়াশুনা করে? এর জবাবে তিনি বলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু সংসার চালাতে হলে পড়াশুনা বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। ছেলেকে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি সবকিছু ওলোটপালট করে দিল। এ জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাঝে মধ্যে ভাড়া না থাকলে রাস্তায় রিকশা দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনি। পরে সেগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেই।
কথা হয় পাঠাও চালক কবির উদ্দিনের সঙ্গে। কবিরের জীবনের গল্প প্রায় রিকশাচালকদের মতোই। সেও বেশি আয়ের জন্য গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলো। কিছুদিন ভালোই আয় করেছেন। কিন্তু জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি উন্নত আয়ের আশা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, এখন অনেকেই বাইকে ওঠেন না। ফলে আয় কমে গেছে। এর বাইরে পুলিশ মামলা দিলে সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখি না। পুলিশের মামলা বিষয়ে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একজন ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের বাইকে নিজেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে। আমরা বাঁচতে চাই। জ্বালানী তেলের দাম আগের অবস্থায় নিয়ে আসুক, সরকার কাছে এটাই দাবি বলে জানান তিনি।
গত ৫ই আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর সবচেয়ে বেশি যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, তার মধ্যে ডিম অন্যতম। ফলে অন্য খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষ এখন অনেক সমস্যায় পড়ে গেছে। তাদের আয় বাড়েনি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। আয়-বৈষম্য বেড়ে গেছে। সরকারের উচিত সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা।
ভুক্তভোগীরা জানান, নিত্যপণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর চাল, ডাল, তেল, আটা, মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ, শাকসবজির মতো নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। ফলে প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো। এ
ছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষ বিশেষ করে কম আয়ের শ্রমিক কিংবা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। তাদের খরচ শুধু বাড়ছেই। সংসার ঠিকমতো চালাতে পারছেন না। টিকে থাকতে চাহিদার চেয়ে কম কিনছেন। কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। নিম্ন-আয়ের মানুষেরা যে ডিম খাবে তারও উপায় নেই।
বাংলা ম্যাগাজিন এস/কে