রাজধানীর বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বলছে না, ক্ষতিগ্রস্থ শিল্প উৎপাদন

গ্যাস–সংকটের কারণে এখন রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চুলা জ্বলছে না।আবাসিকের পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে অনেক সিএনজি স্টেশন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একই পরিস্থিতি শিল্পে। গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক সময়ের মতো কারখানা চালানো যাচ্ছে না, কমছে শিল্পের উৎপাদন। পরিবহন খাতও ভুগছে গ্যাস–সংকটে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কয়েক দিন ধরে এ সংকট চললেও সমাধানের উদ্যোগ নেই। গ্যাস না থাকায় ঢাকার অধিকাংশ বাসাবাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুলা জ্বলছে না। ফলে রান্না প্রায় বন্ধ। খাবারের জন্য বাড়ির লোকজনকে আশপাশের হোটেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। হোটেলগুলো সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের সংকট বেড়েছে।  গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন এরই মধ্যে তিন ভাগের একভাগ কমে গেছে।

দেশে দিনে মোট ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। কারণ, চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ আড়াই মাস ধরে।

অন্য সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অথবা সার কারখানায় সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা হতো। এখন সেই সুযোগটিও নেই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প জ্বালানি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। ফলে গ্যাস দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। সার কারখানা বন্ধ করে দিলেও বিপদ। বিশ্ববাজারে সারের দাম চড়া, আমদানিতে বাড়তি খরচ লাগছে। তাই দেশি সার কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই যে সব খাতেই এখন গ্যাস–সংকট চলছে। ঢাকার বাসিন্দারা কেউ কেউ রাতে অথবা খুব ভোরে উঠে রান্না করছেন। কেউ কেউ কিনেছেন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার। তাঁদের এলপিজির দামও দিতে হচ্ছে। আবার সরকারি গ্যাসের বিলও পরিশোধ করতে হচ্ছে।

তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, আগে তাদের গ্যাসের ঘাটতি ছিল ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তীব্র শীতের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, শনিবার গ্যাস উৎপাদন হয়েছে ২৬৪৯ মিলিয়ন ঘুনফুট। কিন্তু এই দিন সরকারি ছুটি থাকলেও চাহিদা ছিল ৩৩৯৯ মিলিয়ন ঘুনফুট। শীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানাগুলো চালু থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তবে সংকট তীব্র হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে অবৈধ সংযোগ।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান বলেন, শীতের কারণে রাজধানীর বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে ২৪ ঘণ্টা চুলা জ্বালিয়ে রাখে। সে কারণে ২৫০ মিলিয়ন ঘুনফুট গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, এমনিতে ৫০০ মিলিয়ন সরবরাহ কম থাকায় তাদের হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর এখন চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ঘুনফুট। কাজেই এ অবস্থায় তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই। গ্যাসভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানা বন্ধ না করলে রাজধানীর এ সংকট কমানো সম্ভব হবে না।

জানা গেছে বর্তমানে রাজধানীর কিছু এলাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেশিরভাগ সময় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এসব এলাকায় সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা, কোথাও বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। আবার কোথাও সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাসের চুলাই জ্বলে না। এসব এলাকার অধিবাসীরা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরুরি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে দৈনিক গড়ে ৫০০’র বেশি অভিযোগ করছেন। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় অভিযোগের কোনো সুরাহা করতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ।

এদিকে আবাসিকের পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেক সিএনজি স্টেশন। তেজগাঁও, শ্যামপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকার সিএনজি স্টেশনেও গ্যাসের চাপ ঠিক থাকছে না। গাজীপুর, কোনাবাড়ী, শফিপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প কারখানাগুলোয়ও দিনে গ্যাসের চাপ থাকে না। তবে এ ধরনের গ্যাস সমস্যা কতদিন চলবে, কেউ জানেন না।

দেশে দুভাবে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়—দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রে থেকে উৎপাদিত এবং আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। দিনে দেশি গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস সরবরাহ করা হতো ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। আর এলএনজি আমদানি হতো ৭০ থেকে ৭৫ কোটি ঘনফুট। এখন এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে ৪৮ কোটি ঘনফুট।

সমস্যা হলো, বিশ্ববাজার থেকে এখন পর্যাপ্ত এলএনজি কিনতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ, দাম অত্যন্ত চড়া। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এলএনজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। রাশিয়ার গ্যাস না পেয়ে ইউরোপের দেশগুলো খোলাবাজার থেকে কিনছে। এতে দরটি বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরকারও খোলাবাজার থেকে চড়া দামে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।

দেশে এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এ কোম্পানির সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো (জাহাজ) আনা হচ্ছে। এতে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম পড়ছে এখন প্রায় ১৫ মার্কিন ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই দর ছিল ১০ ডলারের কম। আর সিঙ্গাপুরের খোলাবাজার থেকে কেনা এলএনজি নিয়ে প্রতি মাসে তিনটি করে জাহাজ আসার কথা। এখন বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৬০ ডলারের বেশি। গত জুনেও তা ৩৬ ডলারে ছিল। গত বছর নেমেছিল ৪ ডলারে।

গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

এতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র বলছে, গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমার পরিস্থিতি বৈঠকে তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা। তবে পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা পাননি ব্যবসায়ীরা। শুধু শীতে বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা কমলে শিল্পে সরবরাহ বাড়তে পারে।

অভিযোগ আছে, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দিয়ে সরকার আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। এ আমদানিনির্ভরতাই সংকট তৈরি করেছে। এখন দেশীয়ভাবে যে গ্যাস উৎপাদিত হয়, তার ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে শেভরন। এক কোম্পানির ওপর এমন নির্ভরতাও ভোগাতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এখন দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। এটি আগে থেকেই করা উচিত ছিল।

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, ইউরোপ এলএনজির বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। দাম আরও বাড়তে পারে। তাই পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, অবশেষে সরকার দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে, যা পাঁচ বছর আগেই করা উচিত ছিল। তবে রাতারাতি গ্যাস পাওয়া যাবে না।আমদানিনির্ভরতা ভুল নীতি ছিল। তাই এখন ভুগতেই হবে, এটা কৃতকর্মের ফল।

Exit mobile version