ভারতের ঋণ নিয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে বাংলাদেশ!
২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে ১০০ কোটি ডলার রাষ্ট্রীয় ঋণ (এলওসি) অনুমোদন করে ভারত। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে আরও ২০০ কোটি ডলার ঋণের ঘোষণা আসে। আর ২০১৭ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় আরও ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। যদিও এসব ঋণের সামান্যই ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ।এদিকে আজ আবার ভারত সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনীতির নতুন মেরুকরণ, জ্বালানি নিরাপত্তা, দুই দেশের রেল খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইস্যু রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে।
তবে এবার আর নতুন করে ভারতের ঋণ নিতে আগ্রহী না বাংলাদেশ। এজন্য কোনো প্রস্তুতিও নেয়া হয়নি। মূলত ঋণ ছাড়ে নানা জটিলতা, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি ও জটিল শর্তের কারণে ভারতের ঋণ ব্যবহারে বাংলাদেশের আগ্রহ কমে গেছে।তথ্যমতে, ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার কথা ৭৩৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ১২২ কোটি ৮৯ লাখ ডলার, যা মোট ঋণের মাত্র ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বাকি ঋণ দ্রুত ছাড় করতে ভারতের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তবে নানা জটিলতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসির বিভিন্ন প্রকল্প এখনও অনুমোদনই হয়নি। তাই সেগুলোর বাস্তবায়ন ও ঋণছাড় দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে।প্রথম এলওসির আওতায় ১৫টি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১টি পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং একটি প্রকল্পের আংশিক বাকি থাকতেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
বাকি তিনটি প্রকল্প চলছে প্রায় এক দশক ধরে, যার সবগুলোই রেলওয়ের। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন গতি খুবই ধীর। তাই কবে নাগাদ এ প্রকল্প তিনটি শেষ হবে, তা সংশ্লিষ্টদের কেউ নিশ্চিত নন।দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ১৫টি প্রকল্প নেয়া হলেও পরে তিনটি বাদ দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে দুটি শেষ হয়েছে, তিনটি ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে রয়েছে এবং সাতটি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। আর তৃতীয় এলওসির আওতায় ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও একটি বাদ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সাতটির ডিপিপি প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে আছে ও দুইটি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলো থেকে চারটি বাদ দেয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং দুইটি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
সূত্রমতে, ২০১০ সালের ৭ আগস্ট দুই দেশের মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম এলওসি ঋণচুক্তি হয়। পরে প্রথম ঋণচুক্তি থেকে ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে মঞ্জুর করে ভারত। তবে প্রকল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরে প্রথম এলওসির আওতায় আরও ছয় কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ অনুমোদন করে ভারত। এতে প্রথম এলওসির আকার দাঁড়ায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার ছাড় হয়েছে।২০১৬ সালের ৯ মার্চ দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ২০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়।
এর মধ্যে ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার ছাড় হয়েছে। আর তৃতীয় ঋণচুক্তি হয়েছে ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর। এর আওতায় ৪৫০ কোটি ডলার থেকে ২৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার এখন পর্যন্ত ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ।এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের জন্য এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো। তবে এবারের ভারত সফরসূচিতে নতুন কোনো ঋণচুক্তি সই নিয়ে এজেন্ডা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। তবে সিরাজগঞ্জ আইসিডি (অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো) নির্মাণে ভারতের ৪৯ মিলিয়ন (চার কোটি ৯০ লাখ) ডলার অনুদান দেয়ার কথা রয়েছে। এ-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।যদিও ভারতের ঋণের আওতায় নতুন করে ২৬০টি ব্রডগেজ কোচ কিনতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি)।
গত সপ্তাহে ইআরডির বৈদেশিক ঋণ অনুমোদন-সংক্রান্ত বৈঠকে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে হলে প্রথমে তাতে আপত্তি জানানো হয়।ইআরডির পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়, ভারতের সঙ্গে নতুন করে এলওসি চুক্তি হচ্ছে না। তাই ভারতের ঋণে ২৬০টি কোচ কেনা প্রকল্পটি অনুমোদন করা সম্ভব নয়। সে সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি রেলপথমন্ত্রী ভারত সফরকালে ২৬০টি ব্রডগেজ কোচ সরবরাহের প্রস্তাব দেন। এতে সম্মতি জানায় দেশটি। এক্ষেত্রে ঋণ সরবরাহের আশ্বাসও দেয় ভারত। এজন্য প্রস্তাবটি ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে।এর পরিপ্রেক্ষিতে ইআরডির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, প্রজেক্ট টু প্রজেক্ট বেসিসে ভারতের ঋণ পাওয়া গেলে ভিন্ন বিষয়। তবে জিটুজি ভিত্তিতে ভারতের এলওসি আপাতত নেয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এ ধরনের কোনো এজেন্ডা রাখা হয়নি।
তাই ভারত যদি ২৬০টি কোচ কেনার জন্য প্রজেক্ট বেসিসে ঋণ দেয়, তাহলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।সূত্র জানায়, প্রথম এলওসির বেশিরভাগ ঋণ ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে আর বিআরটিসি (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন)। তবে প্রথম এলওসির আওতায় কেনা বিআরটিসির বাসের করুণ অবস্থা। ভারতের ঋণ ২০১২ সালে ২৯০টি দ্বিতল বাস, ৮৮টি এসি বাস ও ৫০টি আর্টিকুলেটেড (দুই বগির জোড়া লাগানো) বাস কেনা হয়। এর বড় অংশই অচল হয়ে পড়েছে।তৃতীয় এলওসির আওতায়ও ৬০০ বাস ও ৫০০ ট্রাক কেনে বিআরটিসি। তবে ২০১৮ সালে কেনা এসব বাস-ট্রাকের একটি অংশ বিকল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিআরটিসির ট্রাকের মান নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে।
অথচ এখনও এ ঋণ পরিশোধ করা শুরু হয়নি।এদিকে ভারতের ঋণের আওতায় ৬৫ শতাংশ পণ্য ও ৭৫ শতাংশ পরামর্শক দেশটি থেকে আমদানি করতে হয়। অনেক সময় এসব পণ্য ভারতেও পাওয়া যায় না। তাই এ শর্তটি ভারতের ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের বাধা বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ভারতের হাইকমিশন হয়ে দেশটির এক্সিম ব্যাংকে প্রকল্পের সব ধরনের নথিপত্র বারবার পাঠাতে হয়। এটিও ভারতের ঋণের বড় সমস্যা বলে মনে করা হয়।
বাংলা ম্যাগাজিন /এনএইচ