উন্নয়নচট্টগ্রামবাংলাদেশ

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ চলাচল ব্যবস্থাপনাসহ ১২টি বাধা

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ বা টানেলের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরে টানেলের ভেতর দিয়ে যান চলাচল শুরু হতে পারে। তবে টানেলের পুরোপুরি সুফলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকার নির্মাণাধীন গোলচত্বরে যান চলাচল ব্যবস্থাপনাসহ ১২টি বাধা। এই গোলচত্বর হয়েই টানেলের গাড়ি আসা-যাওয়া করবে।

চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে গঠন করা কমিটি এসব বাধা চিহ্নিত করলেও এখন জানা যাচ্ছে, সমস্যার শিগগির সমাধান হচ্ছে না। বাধা দূর করতে আউটার রিং রোড প্রকল্পও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেটি এখনো অনুমোদন হয়নি বলে জানায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের প্রথম এই টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে।

মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। আর আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়ালসেতু। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ। টানেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

নির্মাণকাজ শেষ হলে টানেল ব্যবহারকারী সব গাড়ি বর্তমান নকশায় বিদ্যমান গোলচত্বর দিয়ে চলাচল করবে। আবার এই গোলচত্বর দিয়ে চলাচল করবে চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড, লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সৈকত সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক ও সৈকতে আসা গাড়িগুলো।

আবার বন্দরের ও রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করবে টানেল দিয়ে। কিন্তু বিদ্যমান নকশার গোলচত্বর এত গাড়ির চাপ সামাল দিতে পারবে না। যান চলাচলের বাধা দূর না হলে টানেলের দুই প্রান্তে যানজটের শঙ্কা রয়েছে। এ জন্য গোলচত্বর ব্যবস্থাপনা নতুন করে সাজাতে হবে বলে মত দিয়েছে কমিটি।

গোলচত্বরের ব্যবস্থাপনা ছাড়াও পতেঙ্গা প্রান্তে আরও ছয়টি বাধা রয়েছে। প্রথমত সিডিএ নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর ও নিচের সড়ক দিয়ে পতেঙ্গার দিকে আসা গাড়িগুলো আউটার রিং রোড এবং টানেল অভিমুখে সরাসরি যেতে পারবে না। আবার টানেল দিয়ে আসা গাড়িগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে লালখান বাজার এবং বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় ডান দিকে বাঁক নিতে গেলে সমস্যা তৈরি হবে।

দ্বিতীয়ত টানেলগামী যানবাহনগুলোর জন্য ওজন স্কেলের অবস্থান গোলচত্বর থেকে মাত্র ২০০ ফুট দূরে। অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে টানেলের গোলচত্বর এলাকায় যানজট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

তৃতীয়ত পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে আসা পর্যটকদের বহনকারী বড় গাড়িগুলোর সৈকতসংলগ্ন পার্কিং এলাকায় যাওয়ার সুযোগ নেই। চতুর্থত বিমানবন্দর থেকে আউটার রিং রোডগামী যানবাহনগুলোর নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে জি-১ (বিমানবন্দরমুখী) এবং জি-২ সড়কের (আউটার রিং রোডমুখী) সংযুক্তকারী মোড়।

এ ছাড়া আরও দুটি বাধার একটি চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জেটি ও কনটেইনার ইয়ার্ড থেকে আসা গাড়িগুলো টানেলের পতেঙ্গার গোলচত্বর ব্যবহার করবে। অপরটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট ক্রসিং এলাকায় আউটার রিং রোড, টোল সড়ক ও বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়কে মিলিত হয়েছে। এই অংশে দুই দিকের গাড়ি ডান দিকে বাঁক নিতে গেলে যানজট তৈরি হবে।

সিডিএ সূত্র জানায়, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বাড়তি ব্যয় হতে পারে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। তবে ফৌজদারহাটে ইউলুপ নির্মাণে কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি।

সিডিএর দাবি ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেই টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। কাজও শেষের দিকে। টানেল চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যাবে, তা কিন্তু না। আপাতত ২০৩৬ সাল পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই।

এদিকে আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে পাঁচটি বাধা। এর মধ্যে অন্যতম টানেলের সঙ্গে সংযুক্ত আনোয়ারা প্রান্তের পিএবি সড়কে ইউলুপ না থাকা, মেরিন একাডেমি থেকে সিইউএফএল পর্যন্ত সড়কের অপ্রশস্ততা, সংযুক্ত সড়কে চার লেনের সেতু না থাকা ও টোল আদায়ে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু না হলে সমস্যা তৈরি হবে।

এ ছাড়া টানেলের সংযোগ সড়ক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন ছয় লেন সড়কের মোড়ে টানেল থেকে আসা গাড়িগুলোর ডান দিকে বাঁক নিতেও সমস্যা হবে। এ জন্য এসব সমাধানের সুপারিশ করেছে কমিটি।

কিন্তু এই মুহূর্তে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের দোহাজারী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ছয় লেন সড়কের প্রকল্প পরিচালক সুমন সিংহ ।

যেহেতু ডিসেম্বরে টানেল চালু হবে, সে জন্য ছয় লেন সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইউলুপসহ অন্যান্য সুপারিশ বাস্তবায়নে নতুন করে প্রকল্প নেওয়া হবে। তবে তা ডিসেম্বরের আগে হবে না।

কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হওয়ার পরও যানজট ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা থেকে যাবে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ সুভাষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রকল্পের বিষয়গুলো মাথায় রেখে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। টানেল এলাকায় উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলা ম্যাগাজিন /এমএ

Back to top button