বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের সংগ্রহে থাকা ইভিএম দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোটগ্রহণ করা সম্ভব। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড়শ’ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে আরও ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। বাংলাদেশি টাকায় যা ৫ হাজার কোটি টাকা।
দেশে চলমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যে বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যয় করে ইভিএম কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সুজন নেতৃবৃন্দ। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নতুন ইভিএম কিনতে হলে অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। অন্যদিকে আমরা চরম সংকটে আছি। আমরা যেখানে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ করার চেষ্টা করছি। অর্ধ বিলিয়ন ডলার এ কাজে ব্যয় হলে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের উপযোগিতা’ বিষয়ক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব তথ্য জানান। ইভিএমের বিভিন্ন কারিগরি দিক পর্যালোচনা করা হয় এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব তুলে ধরা হয়।
ড. মজুমদার বলেন, এমন অবস্থায় এটি কতোটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার বোধগম্য নয়। গত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে ৩০ শতাংশ ভোট কম পড়েছে। আমাদের শঙ্কা নির্বাচন কমিশনের সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি নিয়ে।
তিনি বলেন, যদি ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট হয় এবং একটি দলকে ইসি ১৪০টি আসন দিয়ে দেয় তাহলে পেপারে লিখিত না থাকলে এটিই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। কুমিল্লায় এভাবেই হয়েছে। ইভিএমে যাচাই-বাছাই করার আর কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের কমিশনার যেন দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না। এর মানে তারা অন্ধ ও কালা। তারা কি উদ্দেশ্যে ইভিএম করছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো ব্যালটের ১১০ শতাংশ ভোট, নাকি ইভিএমের ৫৩ শতাংশ ভোট, কোনটি ভালো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যেন কোনোটাই না হয় তা নিশ্চিত করা। এটা নিশ্চিত না হলে তাদের ব্যর্থতা। এই দায় তাদেরকে নিতে হবে।
জার্মান জুডিশিয়ারির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ইভিএম মেশিন সঠিক হতে পারে। কিন্তু ভোটারদের এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। এ জন্য আমরা ইভিএম থেকে সরে এসেছি। উন্নত দেশগুলো সরে এসেছে। কিন্তু আমরা কি উদ্দেশ্যে, কার স্বার্থে, কেন ইভিএমে নির্বাচন করছি এটা আমাদের মনে বিরাট প্রশ্ন।
গত নির্বাচনে ইভিএমকে কেন প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইভিএম একটা দুর্বল যন্ত্র। গত নির্বাচনে যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থায় কিছু আসে যায় না। তখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয়নি। গত নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এবারের নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক এবং সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করবো। এজন্য ইভিএম বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করি।
বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা আছে, যদিও যে কোনো ডিজিটাল অডিট ট্রেইলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। তবে ব্যবস্থাটি যেহেতু সফটওয়্যারচালিত, তাই সোর্স কোড সংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে।
নির্বাচনের ঠিক পূর্বে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রতিটি ইভিএম মাদারবোর্ড পরীক্ষা করা, পরীক্ষা শেষে প্রত্যেক সফটওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ (ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট) সংরক্ষণ করা দুরূহ কাজ, বলতে গেলে অসম্ভব।
মাঠ পর্যায়ের প্রিজাইডিং অফিসারদের তথ্যমতে, বর্তমান ইভিএমের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে মেশিন হ্যাং হওয়া। ব্যক্তি ভোট পরিবর্তন করতে, অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক ব্যালটে চাপ, দ্রুত একাধিক বাটনে চাপ দিলেই মেশিনটা হ্যাং হয়ে যায়।
একবার মেশিন হ্যাং করলেই ৫ থেকে ১০ মিনিট নষ্ট হয়, মেশিন পুনরায় সিনক্রোনাইজেশান বা রিস্ট্যার্ট দিতে হয়। এতে ভোট গ্রহণের হার কমে যায়। আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সুজন সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডলসহ বিশিষ্টজনরা।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে প্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, দেশের সব নাগরিকের নিখুঁত বায়োমেট্রিক তথ্যশালা ঠিকঠাক তৈরি হয়নি বলে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিষয়ক লাখ লাখ অভিযোগ আছে। নতুন সমস্যা হচ্ছে, প্রায় কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যাওয়া।
‘ধারণা করা হচ্ছে, সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ কোটি জন্মনিবন্ধন একেবারেই গায়েব হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের মধ্যে কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরিসহ, বিদ্যমান এনআইডি’র কোটি ভুল শুধরানো অসম্ভব। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যেখানে নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যশালাই তৈরি হয়নি, সেখানে অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোটের যৌক্তিকতা কোথায়?
তিনি বলেন, একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য ঐ কেন্দ্রের সব ইভিএমে থাকে না বলে, একটি ইভিএম হ্যাং করলে বা একটি ইভিএমের ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে তাকে অন্য ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় না। যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে ইভিএমকে কাটিং এজ প্রযুক্তি বলা হয়েছে।
কিন্তু আমরা মনে করি, ইভিএম সত্যিকার অর্থে একটা হার্ড কোডেড এবং ভোটার অবান্ধব মেশিন। পোলিং কার্ড ও অডিট কার্ডের সঙ্গে ভোট কেন্দ্রের সমস্ত ভোটারের তথ্য সংযোজন করা নেই বলে, ভুলে এক বুথে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটার অন্য বুথের লাইনে গিয়ে ভোট দিতে পারেন না। এমনকি কেন্দ্রভিত্তিক মাস্টার ডাটাবেজ না থাকায় যেকোনো ভোটার যেকোনো বুথে ভোট দিতে পারেন না।
তিনি আরও বলেন, ইভিএম ইন্টারনেটে সংযুক্ত নয়, তবে ইন্ট্রানেটে সংযুক্ত। অর্থাৎ যন্ত্রগুলো নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে, ফলে ‘বিশেষ প্রভাবশালী’ গোষ্ঠী চাইলে এই প্রাইভেট নেটওয়ার্কেরই অন্য কম্পিউটার থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
তদুপরি যন্ত্রটির ভেতরে আগে থেকেই ইন্সটল্ড করা সিম বা কার্ড জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) স্থাপন করে, ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই যন্ত্রটিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অন্যদিকে অডিট কার্ডের মাধ্যমে কেন্দ্রের বুথ থেকে ফলাফল হস্তান্তরের পরে ঐ কেন্দ্রের ফলাফল এবং পুরো আসনের সব কেন্দ্রের ফলাফল দুটোই ম্যানুয়াল প্রসেসের।
এখানে অডিট কার্ডের চিপের মাধ্যমেও জালিয়াতি সম্ভব। আর পুরো ইভিএম ভোট প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হলেও শুধু ফলাফল তৈরির ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া সম্ভব।
বাংলা ম্যাগাজিন এস/কে