প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে নষ্ট করছে রাশিয়া
একদিকে ইউরোপ যেমন জ্বালানির জন্য হাহাকার করছে, অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে নষ্ট করছে রাশিয়া। ফিনল্যান্ডের সীমান্তের কাছে অবস্থিত পোর্তোভায়া নামের একটি প্ল্যান্টে দৈনিক এক কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের গ্যাস পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে গ্যাস পুড়িয়ে নষ্ট করা হচ্ছে, তা আগে জার্মানিতে রপ্তানি করা হতো। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত মিগুয়েল বার্গার বলেন, অন্য কোথাও বিক্রি করতে পারছে না বলেই গ্যাস পোড়াচ্ছে রাশিয়া।এদিকে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, এতে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। এতে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা বেড়ে যেতে পারে।
রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করার পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-১ শুরু যেখানে, সেখানকার একটি কমপ্রেশর স্টেশনের কাছে পোর্তোভায়ার অবস্থান। গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে এই পাইপলাইন দিয়ে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। এর জন্য রাশিয়ার পক্ষ থেকে কারিগরি সমস্যার কথা বলা হয়েছে।
নরওয়েভিত্তিক জ্বালানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিস্টাড এনার্জির তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার গ্যাস পোড়ানো হচ্ছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে উত্তর–পশ্চিমে পোর্তোভায়ার নতুন একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্ল্যান্টে গ্যাসের এই আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। এ গ্রীষ্মের শুরুর দিকে ফিনল্যান্ড সীমান্তের কাছের লোকজন আগুনের বড় আকারের শিখা দেখতে পান।
মিগুয়েল বার্গার বলেন, রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপের প্রচেষ্টা দেশটির অর্থনীতিতে কঠিন প্রভাব ফেলেছে। তারা গ্যাস বিক্রি করতে পারবে এমন কোনো জায়গা নেই। তাই তারা গ্যাস পুড়িয়ে ফেলছে।
গ্যাসের আগুন নিয়ে কাজ করা ক্যাপটেরিও নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মার্ক দাভিস বলেন, যে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে, তা কোনো দুর্ঘটনার নয়। প্ল্যান্ট চালু রাখার জন্য একটি ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত এটি। প্ল্যান্ট বন্ধ করে দিলে তা আবার চালু করার জন্য কারিগরি সমস্যা বা খরচের হিসাব করে তা বন্ধ করতে চান না এর পরিচালকেরা। এ ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে।
জার্মানির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে এটা রাজনৈতিক পদক্ষেপ। তবে গত জুন মাস থেকে ওই প্ল্যান্টে তাপমাত্রা বাড়তে দেখা যায়। প্রথমে গ্যাস নির্গমনের বিষয়টি ধারণা করা হলেও পরে প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে ফেলার ফলে এই তাপ বৃদ্ধির কারণ বেরিয়ে আসে।
যদিও প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্টে গ্যাস পোড়ানো সাধারণ ঘটনা। সাধারণত প্রযুক্তিগত বা নিরাপত্তার কারণে গ্যাস পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে রুশ ওই প্ল্যান্টে গ্যাস পোড়ানোর মাত্রা বিশেষজ্ঞদের বিভ্রান্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি বিশ্বিবদ্যালয়ের কৃত্রিম উপগ্রহের তথ্য বিশেষজ্ঞ জেসিকা ম্যাকার্থি বলেন, ‘আমি কখনো এলএনজি প্ল্যান্ট থেকে এত বড় শিখা দেখিনি। গত জুন মাস থেকে আমরা এই শিখা বড় হতে দেখেছি। এটা কখনোই কমেনি। এটা আরও বেশি উঁচু হয়েছে।’
নর্ড স্ট্রিম–১ পাইপলাইন দিয়ে যে গ্যাস সরবারহ করা হতো তা সংরক্ষণ করে রাখার বিশাল কারিগরি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রুশ জ্বালানি কোম্পানি গাজপ্রম তাদের নতুন একটি এলএনজি প্ল্যান্টে এই গ্যাস ব্যবহারের কথা ভাবছে। তবে সেখানে গ্যাস নিতে সমস্যায় পড়তে পারে। তাই পুড়িয়ে ফেলাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছে।গাজপ্রমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আর্থিক এবং পরিবেশগত খরচ প্রতিদিনই বাড়ছে। রিস্টাড এনার্জির কর্মকর্তা সিন্ড্রে নুটসন বলেন, আগুনের প্রকৃত কারণ অজানা। এটাও পরিষ্কার নয় যে, এই পরিস্থিতিতে পড়ে রাশিয়া আগামীকালই জ্বালানির দাম কমিয়ে দেবে। তা না হলে রাশিয়া এই গ্যাস নর্ড স্ট্রিম–১ বা অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে রপ্তানি করত।
এই গ্যাস পোড়ানো ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ফলাফলও হতে পারে। ফিনল্যান্ডের এলইইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইসা ভাকিলাইনেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আগুন জ্বলতে থাকার অর্থ সেখানে কিছু যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থাকায় তেল ও গ্যাস প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় ভাল্ভ তারা পাচ্ছে না। কিছু ভাল্ভ ভেঙে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তারা সেগুলো বদলাতে পারছে না।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, রাশিয়ার গ্যাস জ্বালানোর রেকর্ড আছে। বিশ্বে গ্যাস পোড়ানোর দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষে রাশিয়া। এই গ্যাস পোড়ানো থেকে বিশ্বে প্রতিদিন ৯ হাজার টন কার্বন ডাই–অক্সাইড ছাড়ছে।করোনা মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। এতে জ্বালানি সরবরাহকারীরা ব্যাপক চাপে পড়েছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। ইউরোপের সরকারগুলো রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কমাতে নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর আগে ইউরোপের মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ আসত রাশিয়া থেকে। এখন ভিন্ন উৎসের গ্যাসের দামও বেড়ে গেছে। জার্মানি ও স্পেনে তাই এখন জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে