সিলেটের বালুচরে আফিয়া হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে। শিলনোড়া দিয়ে মাথায় উপর্যুপরি আঘাতের পর হত্যা করা হয় আফিয়াকে। পাওনা টাকা না দেয়ায় গত রোববার রাতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে সাবলেটে ওই বাসায় বসবাসকারী মাজেদা বেগম মুন্নী। এরপর সে দুই বছরের শিশুকন্যাকে আফিয়ার মৃতদেহের পাশে রেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে পালিয়ে যায়। মায়ের মৃতদেহের পাশে দুইদিন ছিল শিশুটি। লাশে পচন ধরে বাইরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় আফিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
গতকাল বিকালে র্যাব-৯ এর সিও উইং কমান্ডার মো. মোমিনুল হক আসামি মাজেদাকে গ্রেপ্তার ও রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এ সময় মায়ের পচন ধরা লাশের পাশে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া শিশুকন্যাকেও গণমাধ্যমের সামনে হাজির করেন। তিনি জানান, ‘মা হারা ওই শিশুটি এখন সুস্থ। নানি কুটিনা বেগমের হেফাজতে আছে।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, আফিয়া বেগম ওরফে সামিয়ার বাড়ি সিলেটের গোয়াইনঘাটে। কয়েক বছর আগে আশরাফ নামে এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিলো। আশরাফের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার ইসমত খানের ছেলে ইসমাইল নিয়াজ খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তবে ওই বিয়ের বৈধ কাগজপত্র নেই। মাওলানা ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হয় বলে দাবি করেছে আফিয়ার পরিবার।
বিয়ের পর থেকে শিশুকন্যাকে নিয়ে বালুচরের বাবর তফাদারের মালিকানাধীন ফোকাস ৩৬৪ নম্বর বাসার নিচতলায় ভাড়া থাকেন আফিয়া। স্বামী মাঝে মধ্যে তার বাসায় যান। ফলে শিশুকন্যাকে নিয়ে একাই বাসায় বসবাস করেন আফিয়া। পরবর্তীতে তিনি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের সারংপুর গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে মাজেদা বেগম মুন্নীকে সাবলেট হিসেবে তার বাসার একটি কক্ষ ভাড়া দেন। বাসা সাবলেট নিলেও মাজেদা ওই বাসায় থাকতেন না। মাসে ৫-৭ দিন তিনি বসবাস করতেন। বাকি সময় তিনি অন্যত্র বসবাস করতেন।
এদিকে- একই বাসায় বসবাসের সুযোগে আফিয়ার সঙ্গে মাজেদার ভালো সম্পর্ক হয়। মাজেদা প্রায় সময় আফিয়ার কাছে টাকা জমা রাখে। এর পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার টাকার মতো। সম্প্রতি মাজেদা বেগম তার রক্ষিত টাকা আফিয়ার কাছে চায়। কিন্তু আফিয়া টাকা দিচ্ছিলো না। এক পর্যায়ে আফিয়া টাকা রাখার বিষয়টি অস্বীকার করে। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
গত ১৮ই আগস্ট বালুচরের বাসায় যায় মাজেদা বেগম। রাতে সে আফিয়ার কাছে টাকাও চায়। এ নিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে ঝগড়াও হয়। আফিয়া টাকা দেবে না বলে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মাজেদা বেগম আফিয়াকে খুনের পরিকল্পনা করে। ২০শে আগস্ট রাত ১০টার দিকে আফিয়ার কাছে ফের টাকা চায় মাজেদা। কিন্তু আফিয়া টাকার বিষয়টি অস্বীকার করে।
এ সময় ফের তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। ওইদিন মধ্যরাতে মাজেদা বেগম রান্নাঘর থেকে শিলপাটা এনে আফিয়ার মাথায় পরপর দুটি আঘাত করে। এতে আফিয়া বেগমের মৃত্যু হয়। এদিকে- আফিয়াকে খুন করলেও রাতে মাজেদা বাসা ছাড়েনি। পরদিন সকাল ৬ টার দিকে সে বাইরে থেকে দরজা তালা দিয়ে রিকশাযোগে পালিয়ে বানিয়াচংয়ের নিজ বাড়িতে চলে যায়।
এদিকে- খুনের ঘটনার পর দুই দিন আফিয়ার মরদেহ বাসায় ছিল। দুই বছরের শিশুকন্যাও ছিল তার পাশে। আত্মীয় স্বজনরা খোঁজ না করায় খুনের ঘটনা জানাজানি হয়নি। পরে লাশে পচন ধরার পর প্রতিবেশীরা পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে শাহপরান থানার পুলিশ গিয়ে মধ্যরাতে আফিয়ার পচন ধরা মরদেহ উদ্ধার করে। ঘটনার তদন্তে র্যাব সদস্যরা ‘ঘাতক’ মাজেদাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
একপর্যায়ে মাজেদা র্যাবের কাছে খুনের ঘটনা স্বীকার করে। র্যাব-৯ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মো. মোমিনুল হক জানিয়েছেন- ‘পাওনা টাকার কারণে আফিয়াকে খুন করা হয়েছে বলে মাজেদা জানিয়েছে। এবং এই খুন সে একাই করেছে। তার সঙ্গে আর কেউ জড়িত ছিল না বলে জানিয়েছে।’ তিনি জানান, ‘পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের জন্য মাজেদাকে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
এদিকে- আফিয়া খুনের ঘটনায় তার মা কুটিনা বেগম বাদী হয়ে বুধবার শাহপরান থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় তিনি আসামি অজ্ঞাত রাখলেও মেয়ের স্বামী ইসমাইল নিয়াজ খানের কথা উল্লেখ করেন। শাহপরান থানার ওসি আনিসুর রহমান জানিয়েছেন- ‘নিহত আফিয়ার মায়ের অভিযোগের সূত্র ধরে স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে রিমান্ডে আছে।
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মাজেদাকে আফিয়ার স্বামী নিয়াজ খানের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এতে ঘটনার আরও অনেক কিছুই খোলাসা করা হবে। এতে নিয়াজ খান ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা- সেটিও বেরিয়ে আসবে বলে জানান তিনি।’
বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে