তিনি আওয়ামী লীগের ‘কেউ’ কি না,এই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠছেঃ হাছান মাহমুদ

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, উনি (মোমেন) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ নন।আর কেউ যদি বিদেশে গিয়ে কারও সঙ্গে গল্প করে আসেন, তার দায়দায়িত্ব সরকার বা দলের নয়।মোমেনের বক্তব্য দলের না কি সরকারের এই বিতর্ক ছাপিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের ‘কেউ’ কি না, এই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠছে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির সামান্যতম খোঁজও যাঁরা রাখেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই কিছু ‘বিশেষণ’ বা শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এর প্রথমটি ‘আওয়ামী পরিবার’। দ্বিতীয়টি ‘আওয়ামী পরিবারের সন্তান’। তৃতীয়টি ‘আওয়ামী লীগের লোক’। চতুর্থটি ‘আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিতপ্রাণ’। এই চারটি ‘বিশেষণ’ অনেক ক্ষেত্রে দলে ‘যোগ্যতার’ মাপকাঠিও। কোনো অনুষ্ঠানে প্রিয় নেতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে এগুলো ব্যবহার করেন কর্মীরা।

মাঠে–ময়দানে বা কোনো মিলনায়তনে দেওয়া বক্তৃতায় প্রায়ই শোনা যায়, তিনি ‘আওয়ামী পরিবারের সন্তান’। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় পদ–পদবি পাওয়ার ক্ষেত্রে এসব পরিচিতির বেশ গুরুত্ব আছে। তবে বেফাঁস কিছু বলে কেউ নিজে থেকে ঝামেলায় জড়ালে ওই সব পরিচিতি দিয়ে রক্ষা পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কিছুটা সে রকম অবস্থায় এখন পড়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ‘আওয়ামী লীগের লোক’ হওয়ার পরও তিনি আওয়ামী লীগের ‘কেউ’ কি না, সে প্রশ্ন এখন তাঁকে শুনতে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের যে উপকমিটির অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের কাছে আবদুর রহমান এমন মন্তব্য করেছিলেন, সেই আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। এমনকি ওই অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আব্দুল মোমেনও ছিলেন। আব্দুর রহমানের বক্তব্য পরে নিশ্চয়ই শুনেছেন মোমেন। তাঁর ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটি অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের পাশাপাশি দলের সিলেট মহানগর কমিটিরও সদস্য।

সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এখন পর্যন্ত, পরে কী হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বহু বছরের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি করা হয়। প্রায় ছয় বছর এই দায়িত্ব পালনের পর দেশে ফিরে তিনি দলীয় রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি সিলেট-১ আসন থেকে দলের মনোনয়নও পান। যে আসনে আগে সংসদ সদস্য ছিলেন তাঁর ভাই আবুল মাল আবদুল মুহিত। টানা দুই মেয়াদে (২০০৯-২০১৮) আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন মুহিত।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিলেট-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই দেওয়া হয় এ কে আব্দুল মোমেনকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিতে তাঁকেই বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। এখনো তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কমিটির সদস্যও তিনি। এরপরও তিনি দলের কেউ নন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। সভাপতিমণ্ডলীই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম।

দলের পদ–পদবি বা সরকারের মন্ত্রিত্ব—এসবের বাইরেও নিশ্চিতভাবেই ‘আওয়ামী পরিবারের সদস্য’ আব্দুল মোমেন। এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন—বিষয়টি সামনে এসেছে মূলত তাঁর দেওয়া একটি বক্তব্যকে ঘিরে শুরু হওয়া বিতর্কে প্রেক্ষাপটে। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আব্দুল মোমেনের এই বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেন, ‘এ ধরনের কোনো অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না, করেনি। শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকেও কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।’ ওবায়দুল কাদের আরও বলেছিলেন, ‘যিনি এ কথা বলেছেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। সেটা আমাদের সরকারেরও বক্তব্য না, দলেরও না।’

তবে অনেকে বলেন, আব্দুল মোমেনের কথা যতটা না কূটনীতিসুলভ তার চেয়ে বেশি সোজাসাপ্টা। তিনি এবারই প্রথম যে ‘চরম অস্বস্তিকর’ কিছু বলে ফেলেছেন, বিষয়টি এমন নয়। এর আগেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘স্বামী-স্ত্রীর’ মতো বলে মন্তব্য করেছিলেন।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা ভারতীয়দের অনুরোধ করার কথাও বলেছিলেন। তখন তিনি আওয়ামী লীগের ‘কেউ’ কি না, সে প্রশ্ন কেউ তোলেননি। তাঁর বক্তব্য ব্যক্তিগত বা সরকারের বক্তব্য নয়—এমন কিছুও শোনা যায়নি। তাহলে এখন কেন তিনি দলের ‘কেউ’ কি না, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠল?

তবে আবদুর রহমানের মতো সরাসরি আওয়ামী লীগের কেউ নন বলে মোমেনকে একেবারে ‘নাকচ’ করে দেননি হাছান মাহমুদ। শুধু বলেছেন, তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ নন। অবশ্য আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্যই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নন। এক দেশের কাছে অন্য দেশের চাওয়া–পাওয়া নিয়ে প্রকাশ্য–অপ্রকাশ্য আলোচনা মন্ত্রীরাই করে থাকেন।

পাশাপাশি দুই দেশের কূটনীতিকেরা এ ধরনের আলোচনাকে এগিয়ে নেন। আর কূটনীতিকদের ‘বস’ হিসেবে থাকেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অবশ্য কূটনীতি প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রচলিত আছে—কোনো দেশের কূটনীতিক যদি কোনো বিষয়ে না বলেন এর অর্থ হচ্ছে ‘সম্ভবত’। যদি কোনো কূটনীতিক সম্ভবত বলেন এর অর্থ হচ্ছে ‘হ্যাঁ’। আর কোনো কূটনীতিক যদি সরাসরি ‘না’ বলেন তাহলে তিনি কোনো কূটনীতিকই নন।

বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে

Exit mobile version