অর্থ ও বাণিজ্য

এলএনজি নিয়ে গভীর বিপদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান

স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ঊর্ধ্বমূল্য আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজি এখন কিনতে হচ্ছে ৫৭ ডলারের বেশি দামে। গত দুই মাসে জ্বালানি পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ১৬৪ শতাংশ।

এতে বিপদে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এলএনজি আমদানিকারক দেশগুলো। জ্বালানি পণ্যটির বর্তমান পরিস্থিতি বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য বড় ধরনের বিপত্সংকুল পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে খাতসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে পারছে না দুই দেশ। স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় এলএনজি আমদানি করেও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন সংকটে পড়েছে। গত এক মাসে দুই দেশেই ব্যাপক মাত্রায় লোডশেডিং বেড়েছে।

শিল্প-কারখানায় সরবরাহকৃত গ্যাসের চাপ কমে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে বিশ্ববাজারে এলএনজির দামে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। বিশেষ করে স্পট এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও আর্থিক চাপের মতো জটিল সমস্যায় পড়েছে। ভারতও একই ধরনের চাপের মধ্যে থাকলেও স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়িয়ে দেশটি এলএনজিনির্ভরতা হ্রাস করতে পেরেছে।আইইইএফএর ভাষ্য অনুযায়ী, এশিয়ায় এলএনজিনির্ভর দেশগুলো বিপদে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো বৃহৎ আমদানিকারক দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মজুদ বাড়ানো।

দেশ দুটি এরই মধ্যে শীতের চাহিদা পূরণে ব্যাপক হারে এলএনজি সংগ্রহ বাড়িয়েছে।এদিকে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে বলে আইইইএফএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) দেশ দুটি এলএনজি আমদানি কমিয়েছে যথাক্রমে ৪ ও ৮ শতাংশ। জ্বালানি ঘাটতি ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট এড়াতে উচ্চমূল্য সত্ত্বেও দেশ দুটি এলএনজি আমদানি অব্যাহত রেখেছিল। তার প্রভাবে দেশ দুটির আর্থিক অবস্থা চাপের মুখে পড়েছে।আইএইচএস মার্কিটের তথ্যমতে, পাকিস্তান ২০১৫ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। গত বছর পর্যন্ত দেশটি মোট ৮ দশমিক ৮১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করেছে।

২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি করেছে ৫ দশমিক শূন্য ৮ মিলিয়ন টন।জ্বালানি সংকটে পাকিস্তানে দৈনিক ১৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ ৮ হাজার মেগাওয়াট কমাতে বাধ্য হয় দেশটি। গ্যাস সংকটে পাকিস্তানের পোশাক খাতে রেশনিং করে গ্যাস দিতে হচ্ছে। এর প্রভাবে দেশটি ১ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় হারিয়েছে।চলতি বছরের মে-জুন পর্যন্ত পাকিস্তান স্পট মার্কেট থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ ২৪ ডলার পর্যন্ত এলএনজি কিনতে পেরেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দাম আরো বেড়ে যাওয়ায় স্পট থেকে এলএনজি আমদানির দরপত্র বাতিল করতে বাধ্য হয়। স্পট থেকে পাকিস্তান সর্বশেষ যে মূল্যে এলএনজি কিনেছে, তা দেশটির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির থেকে তিন-চার গুণ বেশি।

তিন বছর ধরেই পাকিস্তানের গ্যাস খাতে অস্থিরতা চলছে। এলএনজি আমদানি বাড়ানোয় দেশটির গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানি বাবদ পাকিস্তানের ব্যয় ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন দেশটির জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকরা।পেট্রোবাংলার বরাত দিয়ে আইইইএফএ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) স্পট মার্কেট থেকে পেট্রোবাংলা মোট ১৮টি কার্গো কেনার পরিকল্পনা নিয়েছিল।

স্পট এলএনজির মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে ওঠায় জুলাইয়ে এ পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সংস্থাটি। বর্তমানে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ।নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা  বলেন, স্পট মার্কেট থেকে যে ১৫০-২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো, সেটি এখন বন্ধ রয়েছে। এর বিপরীতে স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়ানোর কাজ চলছে।স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পেট্রোবাংলা একটা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

এ পরিকল্পনায় সংস্থাটি ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। যার মধ্যে অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়নমূলক কূপ ও কূপ সংস্কারের মতো বড় ধরনের উদ্যোগ রয়েছে।পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, স্পট মার্কেটে প্রতি কার্গো এলএনজির দাম এখন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকার মতো। এ মূল্যে কার্গো আমদানি করার মতো অর্থ পেট্রোবাংলার কাছে নেই। আমরা স্পট মার্কেট থেকে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করতাম, সেটি বন্ধ রেখে স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ দেয়ার চেষ্টা করছি। স্থানীয় গ্যাস খাতের উন্নয়নে আমরা একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি, আশা করছি সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে একটা ভালো ফলাফল আসবে।

এলএনজি আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানি মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরবরাহ চুক্তি ভঙ্গ করেছে। আইইইএফএ বলছে, চুক্তি অনুযায়ী এলএনজিবাহী কার্গো সরবরাহ না করায় পাকিস্তান ১১ দফায় জরুরি ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করেছে। এছাড়া ভারতে গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম এলএনজি সরবরাহের আটটি চালান এড়িয়ে গেছে। কার্গো সরবরাহ না করায় ভারতে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়।দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি বাজারে এলএনজির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমে গিয়েছে বলে উল্লেখ করেছে আইইইএফএ।

সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে গ্যাস সংকটের কারণে এবং এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ ১ হাজার ৬০০ এমএমসিএফডি থেকে ৯০০ এমএমসিএফডিতে নেমে এসেছে। আর এ কারণে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৪০-৫০ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়।জ্বালানি পণ্যটির দামের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে এলএনজি আমদানি ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকায় (৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার) পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরের দ্বিগুণেরও বেশি বলে উল্লেখ করে আইইইএফএ।জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব যে সংকটে পড়েছে তার প্রভাব হয়তো আমাদের দেশেও রয়েছে। তবে আমাদের এখানে সংকটটা আগেই জানা ছিল।

কারণ আমাদের যে গ্যাস কমে যাবে, সেটি গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনাতেই বলা আছে। কী পরিমাণ কমবে তাও বলা আছে। তবে ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ ছিল না। ফলে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সংকটটা বেড়ে গিয়েছে। এখন যে উদ্যোগ জ্বালানি বিভাগ নিয়েছে, তা আরো আগে নেয়া উচিত ছিল। এতে হয়তো সংকট এতটা প্রকট হতো না।

বাংলা ম্যাগাজিন /এনএইচ

Back to top button