ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এযাবৎ যত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে, তার প্রায় অর্ধেক (প্রায় ৫২ বিলিয়ন) মারা গেছে মশাবাহিত রোগে।মশার কারণে সৃষ্ট রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা বা মশক দিবস পালন করা হয়। ১৯৩০ সালের দিকে শুরু হওয়া বিশ্ব মশক দিবসের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৮৯৭ সালের এই দিনে স্যার রোনাল্ড রস একটি অ্যানোফিলিস মশার অন্ত্রের টিস্যুতে ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করেন, যা চিকিৎসা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে।মশা একটি ক্ষুদ্র প্রাণী, যার গড় ওজন প্রায় ২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম এবং এর জীবনকাল দুই মাসের কম।
মশা তাদের জীবনের প্রথম ১০ দিন পানিতে কাটায়। শুধু স্ত্রী মশা মানুষ বা অন্য প্রাণীদের কামড়ায়, কারণ ডিম উৎপাদনের জন্য তার রক্তের প্রয়োজন হয়। স্ত্রী মশা একবারে ৩০০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। পুরুষ মশা গাছের রস, ফুলের মধু প্রভৃতি খায় এবং এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগায়নে সহায়তা করে। পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০টিরও বেশি মশার প্রজাতি রয়েছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি আসলে মানুষকে কামড়ায়।
ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এযাবৎ যত মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে, তার প্রায় অর্ধেক (প্রায় ৫২ বিলিয়ন) মারা গেছে মশাবাহিত রোগে। মূলত তাদের বেশির ভাগই মারা গেছে ম্যালেরিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা মতে, মশাবাহিত রোগে বিশ্বে বছরে প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার লোক মারা যায়। শুধু ম্যালেরিয়ায় সেই সংখ্যা ৬ লাখের বেশি।
সর্বশেষ বিশ্ব ম্যালেরিয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৪১ মিলিয়ন, যেখানে ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ২২৭ মিলিয়ন। ২০২০ সালে ম্যালেরিয়ায় মৃত মানুষের আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ২৭ হাজার, যার অর্ধেকই হচ্ছে সাব-সাহারান আফ্রিকার শিশু।
কিছু অ্যানোফিলিস প্রজাতির স্ত্রী মশা আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। ম্যালেরিয়া আমাদের দেশে ১৩টি জেলায় দেখা গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে এর মূল ঘাঁটি। অ্যানোফিলিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক ও পরিষ্কার পানির প্রয়োজন হয়। তবে, এর কয়েকটি প্রজাতি কিন্তু মনুষ্যনির্মিত পাত্রে বংশবিস্তার করে থাকে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে, এমনকি কলকাতা শহরে এমনই একটি অ্যানোফিলিস মশার প্রজাতি ম্যালেরিয়া ছড়ায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই অ্যানোফিলিস মশার প্রজাতিটি এখনো ঢাকা শহরে আমাদের নজরে আসেনি। আমরা শহুরে লোকজন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে থাকি এডিস মশা নিয়ে। গত বছরগুলোতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া আমাদের এখানে হানা দিয়েছে, জিকা চোখ রাঙাচ্ছে।
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে মারা যায়। অপর দিকে, সাপ, কুকুর, কুমির, জলহস্তী, সিংহ, নেকড়ে ও হাঙর সম্মিলিতভাবে প্রায় ৭৫ হাজার জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই মশাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী বললেও ভুল হবে না।
আমাদের দেশে এখন ডেঙ্গুর মৌসুম চলছে। এডিস ইজিপ্টি হচ্ছে ডেঙ্গু রোগের মূল বাহক মশা। আমরা সবাই জানি যে এডিস ইজিপ্টি মশা বাড়ির আশপাশে পরিত্যক্ত পাত্র, অব্যবহৃত গাড়ির টায়ার, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা, বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্যনির্মিত পাত্রে বংশবিস্তার করে থাকে। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এসব প্রজনন স্থান ধ্বংস করাটাই হচ্ছে মূল বিষয়। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো তিন দিন পরপর পাত্রের পানি পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে।
মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং শান্তির ক্ষতি কমাতে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। সারা বিশ্বে এবং বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে মশা নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য বিষয়। মশার নিয়ন্ত্রণ মোটাদাগে তিনটি ভাবে করা যেতে পারে, যেমন উৎস বা প্রজনন স্থান ধ্বংস, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ।
প্রজনন স্থান ধ্বংস বলতে যেসব স্থানে মশা ডিম পারে বা যেসব স্থানে শূককীট বেড়ে ওঠে সেগুলোকে বিনষ্ট করাকে বোঝায়, যেমন ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার জন্য পরিত্যক্ত অথবা স্বেচ্ছায় জমিয়ে রাখা পানির পাত্রের নিয়ন্ত্রণ। রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, যেকোনো রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মশা অথবা এর শূককীট ধ্বংস করাকে বোঝায়।
আমরা সচরাচর ফগিং করতে দেখি, এটি হচ্ছে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো শূককীট ধ্বংস করার জন্য নিয়মিত ড্রেনে বা সম্ভাব্য প্রজনন স্থানগুলোতে স্প্রে করে থাকে।
আমরা ঢাকা শহরে প্রায়ই যে মশার কারণে নাজেহাল হই, অর্থাৎ সন্ধ্যা ও রাতে যে মশা আমাদের কামড়ায় বা বিরক্তির কারণ, সেটি কিউলেক্স নামে পরিচিত। আপাতদৃষ্টিতে এটি এখনো হয়তো শহর অঞ্চলে কোনো রোগ সৃষ্টি করছে না, কিন্তু এটি দেশের বিভিন্ন স্থানে গোদরোগ ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস ছড়াচ্ছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ২৫ প্রজাতির কিউলেক্স মশা রয়েছে। ঢাকা শহরে এখন যে মশা সচরাচর দেখা যায় না, সেটি হচ্ছে অ্যানোফিলিস।
স্ত্রী মশার ডিমের মাধ্যমে উলবাকিয়া, তা পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর এডিস ইজিপ্টি মশা তা ডেঙ্গু রোগের ভাইরাসটিকে ছড়ানো থেকে বিরত থাকে। এই সাফল্যের পর বিজ্ঞানীরা অন্যান্য রোগবাহী মশার প্রজাতিতে এই প্রযুক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করছেন।
যেহেতু ডেঙ্গু রোগের ভ্যাকসিন এখনো সহজলভ্য নয়, তাই আমাদের দেশে উলবাকিয়া প্রয়োগ করে ভ্যাকসিনের থেকে কম খরচে এডিস ইজিপ্টি মশাকে নীরোগ করা যেতে পারে। এতে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার যেমন কমবে, তেমনি ডেঙ্গুজনিত অসুস্থতার কারণে আর্থিক ক্ষতিও কিছুটা লাঘব হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এডিস ইজিপ্টি মশার মধ্যে উলবাকিয়া নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করে দেখা গেছে যে এটি ডেঙ্গু রোগকে প্রতিরোধ করে। উলবাকিয়া যখন এডিস ইজিপ্টি মশার অন্ত্রে থাকে, তখন তা ডেঙ্গু রোগের ভাইরাসটিকে প্রতিরোধ করে, ফলে তা মশা থেকে মানুষে ছড়াতে পারে না।
বাংলা ম্যাগাজিন / এমএ