দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে থাকা মোহাম্মদ ইমাম হোসেন ও চট্টগ্রাম রেঞ্জ ফোর্স রিজার্ভের কমান্ড্যান্ট অতিরিক্ত ডিআইজি শ্যামল কুমার নাথকে ডিআইজি (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে সিআইডিতে পদায়ন করা হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়টি পুলিশ হেডকোয়ার্টার অবহিত। যিনি তদন্ত করে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছিলেন তিনিও আছেন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার লিখিতভাবে দুর্নীতির বিষয়টি হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করে। তারপরও পদোন্নতি বাগিয়ে নিলেন কীভাবে? এই প্রশ্ন পুলিশের মধ্যে। বর্তমানে কি এমন জরুরি হয়ে গেল যে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে হবে।
পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। এই মূহূর্তে দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি দেওয়ার মানে কী? তাদের পদোন্নতি দেওয়া কি খুবই জরুরি ছিল? তাদের পদোন্নতি না দিলে কি হতো?
এটা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা বলেন, আসলে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা একটি গ্রুপ সুকৌশলে এই কাজটি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিয়ে আসছিল এই চক্রটি, তারা মূলত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির হয়ে কাজ করছে।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের দুই জন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এরা শতভাগ দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সৎ, নিষ্ঠাবান, অভিজ্ঞ ও পেশাদারিত্ব অনেক যোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে এই দুই জনকে পদোন্নতি দেওয়ার মানে হলো, পদোন্নতি-বাণিজ্য অথবা ঠান্ডা মাথায় পুলিশের মধ্যে সরকারকে সমালোচনার দিকে ঠেলে দেওয়ার একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি দেওয়া নয়, তাদের তিরস্কারসহ পদ-অবনতি হতে পারে—এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন তারা। তাদের মতে, যারা যোগ্য অফিসার তারা পাবেন পুরস্কার, আর অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ তারা পাবেন তিরস্কার—এটাই শৃঙ্খলা বাহিনীর মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। সঙ্গে থাকতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনা।
মঙ্গলবার পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে উল্লিখিত দুই কর্মকর্তাকে পদায়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ২০২০ সালের ৩০ মে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো এক চিঠিতে মোহাম্মদ ইমাম হোসেনকে বদলির সুপারিশ করেছিলেন।
চিঠিতে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস) মো. ইমাম হোসেন এক জন দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা। ডিএমপির বিভিন্ন কেনাকাটায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ডিএমপির কেনাকাটায় স্বয়ং পুলিশ কমিশনারের কাছে পারসেন্টেজ নেওয়ার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন।
ফলে ঐ কর্মকর্তাকে ডিএমপিতে কর্মরত রাখা সমীচীন নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। এর ১০ দিন পর তাকে বদলি করা হয় পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম)। এরপর ঐ বছরের ২৯ জুন সিআইডিতে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদায়ন হয় ইমামের।
পুলিশে বর্তমানে কর্মরত অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদায়িত্বের সঙ্গে কাজ করেন এমন অনেক কর্মকর্তা আছেন। তাদের না দিয়ে দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিতদের পদোন্নতি দেওয়া হলো কোন মতলবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ ব্যাপারে জানা উচিত।
আমলাদের একটি গ্রুপ আছে, যারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার পাঁয়তারার অংশ হিসেবে দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি দিতে সহযোগিতা করেছেন বলে পুলিশের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৃহত্তর স্বার্থে যারা এটার সঙ্গে জড়িত তাদের তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
কর্মরত পুলিশের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির লেবাস পরে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছে জামায়াত-শিবির। তাদের অনেকগুলো পদক্ষেপের একটি নমুনা হলো এটি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনাদের কাজ। আবার এক শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন যারা টাকার বিনিময়ে কাজ করেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার পুলিশে যে সুযোগসুবিধা দিয়েছে, তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের ঘুষ খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এই সব ঘুসখোর কর্মকর্তাদের কারণে পুলিশে দুর্নাম হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে পুলিশের মধ্যে এর প্রভাব পড়ে।
প্রজ্ঞাপনে থাকা আরেক কর্মকর্তা শ্যামল কুমার নাথ কক্সবাজারের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি)। ২০১৫ সালে ইয়াবাভর্তি পিকআপ ভ্যান নিয়ে দুজন পুলিশ সদস্য ঢাকায় যাওয়ার পথে কুমিল্লায় দুর্ঘটনাকবলিত হলে ধরা পড়েন। পরে র্যাব এই দুই পুলিশ সদস্যকে আটক করে।
জেলার এসপির বাসা থেকে ইয়াবা পাচারের তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর তৎকালীন এক ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি শ্যামল কুমার নাথের ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ততার তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদন দিলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। সবশেষ গত ১১ মে ৩২ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে ডিআইজি করা হলেও সেখানে নাম ছিল না ইমাম হোসেন ও শ্যামল কুমার নাথের।