ক্রিকেটখেলা

একজন সাকিব ও ক্রিকেটের জিম্মি দশা

বিরাট কোহলিকে ওয়ানডের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার সময় তার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি দেশটির বোর্ড (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী। কদিন পর নিজ থেকেই টেস্টের দায়িত্ব ছাড়েন বিরাট। দীর্ঘদিন রান খড়ায় ভুগতে থাকা বড় তারকা বোর্ডের চাপেই সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হন। এক সময় যে কোহলির চাওয়া পূরণ করতে সফল অনিল কুম্বলেকে সরিয়ে রবি শাস্ত্রীকে কোচ করা হয়েছিল, সেই তিনি এখন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসা রক্ত মাংসের এক মানুষ।

প্রশ্ন জাগে সাকিব আল হাসান কি কোহলির চেয়ে বড় ক্রিকেটার, না বড় সুপারস্টার? কেন বছরের পর বছর মাঠ ও মাঠে বাইরে তার অপেশাদার আর অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ মেনে নিচ্ছে বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। আন্তর্জাতিক ম্যাচে লাইভ সম্প্রচারে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, লাথি দিয়ে স্টাম্প উপড়ে ফেলা, সমর্থককে মারতে যাওয়া, জুয়াড়ির সংশ্রব গোপন করে নিষিদ্ধ হওয়া, দেশের সিরিজ মিস করে ইচ্ছামতো বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশী লিগে খেলা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বিজ্ঞাপনের শূটিংয়ে অংশ নেয়া। নিয়ম-কানুন, নীতি-নৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনের পর দিন তিনি এসব করে আসছেন।সর্বশেষ বেট উইনারের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেট উইনারের নিউজের সঙ্গে চুক্তি ঘিরে ঘটে তুলকালাম কাণ্ড।

বেট উইনার মূলত ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অনলাইন বেটিং কোম্পানি। ক্রিকেট ফুটবলসহ বেশ কয়েক ধরনের খেলায় বাজি ধরা যায় এই সাইটের মাধ্যমে। বেট উইনার নিউজ এই প্রতিষ্ঠানেরই সারোগেট প্রতিষ্ঠান। বিসিবি তাই সাকিবের এই চুক্তি ভালভাবে নেয়নি। বেটিং নিয়ে বিসিবির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের আইনেও বেটিং নিষিদ্ধ। তাইতো বিসিবির কড়া বার্তা ছিল, বেট উইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি বাতিল না করলে আসন্ন এশিয়া কাপে অধিনায়কত্ব তো পাবেনই না, বাদ পড়বেন দল থেকে।বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের এমন বার্তার তিন ঘণ্টার মাথায় চুক্তি বাতিল করার কথা জানান সাকিব! সাকিবের ব্যাপারে এত কড়া হওয়ার সাহস কোথায় পেল বোর্ড? যেখানে অতীতে সাকিব বারবার বোর্ডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন।

কিন্তু অনেক হম্বি তম্বি করলেও বোর্ড সাকিবের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। একদিনের মধ্যেই যখন সাকিব জানালেন, বেট উইনারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করছেন তিনি। সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, সাকিব তো এত সহজে মাথা নোয়ানোর পাত্র নন! অনেকের কাছে পুরো ব্যাপারটা সাজানো মনে হচ্ছে। গুঞ্জন আছে, চুক্তি বাতিল করলেও সাকিবকে দেয়া ১০ কোটি টাকা আর ফেরত নেবে না বেটউইনার!এখানে প্রথম বিষয়, সাকিবের সঙ্গে চুক্তি করতে পারটাই বেট উইনারের জন্য বিশাল বিজয়। তার চেয়ে বড় কথা, এই চুক্তি নিয়ে হুমকি, নতি স্বীকার সব মিলে নাটকীয়তা যা হয়েছে; তাতে বেট উইনারের কাক্সিক্ষত প্রচারণাটা হয়েছে ঝড়ের বেগে। সাকিব কোন সাধারণ কোম্পানির ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর হলে ১০ বছরে যতটা প্রচারণা হতে পারতো, বেট উইনার ৩ দিনে তা পেয়ে গেছে! বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও এখন বেট উইনার চিনে গেছে।

এতকিছুর পরও সাকিব দলে তো ফিরেছেনই, এমনকি বিশ্বকাপ পর্যন্ত টি২০ অধিনায়কের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে তাকে। কেন? কারণ কোহলি বাজে ফর্মে থাকলেও ভারতের ম্যাচজয়ী পারফর্মারের অভাব নেই।এমন কি রোহিত শর্মার অনুপস্থিতিতে ঋষভ পন্থ, হারদিক পান্ডিয়া, শিখর ধাওয়ানও নেতৃত্ব দিয়ে ভারতকে জেতাচ্ছেন। সুতরাং ব্যাটসম্যান কোহলি এবং অধিনায়ক কোহলি- কোন অভাবই বোধ করছে না দল। তাই তাকে তোষামেদেরও কিছু নেই। কিন্তু গত এক দশকে সাকিবের বিকল্প তো দূরে কথা তার ধারের কাছেও নেই বাংলাদেশের কোন অলরাউন্ডার। যে সিরিজগুলোতেই তিনি অনুপস্থিত থেকেছেন সেখানেই একাদশ গঠনে হিমশিম খেয়ে হয়েছে।আসন্ন এশিয়া কাপেই যেমন নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না বিসিবি; ফলে এতকিছুর পরও সাকিব যে বেট উইনার ছেড়ে ফিরে এসেছে, তাতেই বড় স্বস্তি! মোট কথা বিসিবি তার সঙ্গে আপস করায় সাকিবকে বেটিং ইস্যু নিয়ে কোন বেগ পোহাতে হয়নি।

বিসিবি নিজের অবস্থানে যে শক্ত থাকতে পারেনি, তা বোঝা যায় ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুসের কথায়, ‘এটা (বেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া) নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে।সাকিব তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। তার আসলে এটার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঠিক হয়নি। সে বলেছে, কোন ভুল কারণে একটা অনলাইন নিউজ মনে করে এন্ড্রোসমেন্ট করেছিল। এটা ঠিক হয়নি। তাকে বুঝিয়ে বলার পর সে বলেছে, আমি সেখান থেকে সরে এসেছি। এটাই শেষ।’ তবে সাকিব নিজের যতটা না ভুল, তার বিজ্ঞাপনী এজেন্সি ও বেট উইনার প্রতিষ্ঠানের দায় দেখছেন তিনি, ‘হ্যাঁ সাকিবের কাছে মনে হয়েছে সে মিস গাইডেড।’ সাকিব এবারও বিসিবির নিয়ম ভেঙে ছাড় পেয়ে গেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।সামনে এশিয়া কাপ, নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ এবং টি২০ বিশ্বকাপ।

টুর্নামেন্টগুলোতে ভাল করলে তার সকল অপরাধ ঢেকে যাবে আবারও। বারবার বিসিবি কেন আপোস করছে, সেই প্রশ্নও উঠেছে আবার? জালাল ইউনুস বলেছেন, ‘সাকিব এখনও আমাদের সেরা খেলোয়াড়। আমরা তাকে আমাদের বলেই দাবি করি। সে আমাদের বোর্ডের বা দেশের বাইরের কেউ না। সে যখন বলেছে যে, সে ভুল করেছে, আমরা ধরে নিয়েছি পরবর্তীতে এরকম ভুল আর হবে না। তাকে বলা হয়েছে, এই রকম ভুল যেন সে আর পুনরায় না করে। সে আশ্বাস দিয়েছে, আমাদের বোর্ড সভাপতির সামনে, আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। সেখানে আমরা বিষয়টি শেষ করে দিয়েছি।’সন্দেহ নেই সাকিব বিশ্বসেরা। এই মুহূর্তে অবসর নিলেও বাংলাদেশ তো বটেই ক্রিকেট ইতিহাসেরই কিংবদন্তিদের তালিকায় থাকবে তার নাম। এটা দেশের জন্য অনেক বড় গর্বের। পাশাপাশি তার অপকর্মের তালিকাটাও অনেক লম্বা।

জুয়ারির সঙ্গে গোপন যোগাযোগ, সেই অপরাধে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় এক বছর মাঠের বাইরে কাটানো, বিসিবিকে থোড়াই কেয়ার করা, মাঠে এসেও বিশ্বকাপের টিম ফটোসেশনে অংশ না নেয়া, ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, দর্শক পেটানো, ভক্তের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা, করোনার বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো, আম্পায়ারের দিকে তেড়ে যাওয়া, দেশের হয়ে না খেলার হুমকি দেয়া, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরও বারবার যেনতেন কারণে ছুটি চাওয়া, বিশ্রামের কথা বলে ছুটি নিয়ে শেয়ারবাজারের পক্ষে প্রচারণা চালানো, খেলার চেয়ে ব্যবসায় বেশি সময় দেয়া, শ্রমিকদের বেতন না দেয়া।এত কিছুর পরও মাঠে নামলে সাকিবই সেরা। মুহূর্তেই মানুষ ভুলে যায় সাকিবের মাঠের বাইরের সব অপকর্ম। বারবার সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোস্টার বয়।

সর্বোপরি বিতর্কে জড়ানো সাকিবের নতুন কিছু নয়। এর আগে গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করেছেন বিসিবির অনুমতি না নিয়ে। সিপিএল খেলতে গিয়েছেন অনাপত্তিপত্র না নিয়ে। এগুলো হরহামেশাই হয়েছে। বিসিবিও কখনও তাকে শাস্তি দিয়েছে, কখনও দেয়নি। দলের সেরা খেলোয়াড় বলেই বিসিবির অসহায়ত্ত বারবার ফুটে ওঠে। জালাল ইউনুসের কণ্ঠেও ছিল একই সুর, ‘সেরা খেলোয়াড় হলেই, শৃঙ্খলা বা কোড অব কডাক্ট ভাঙলে আপোস করা ঠিক না।হয়তো এটাও আপোস করা উচিত না। দলের স্বার্থে যেহেতু সে বলেছে সামনে এরকম কোন সমস্যা হবে না। আমরা আশা করি সামনে এটা আর সে পুনরায় করবে না। এই চিন্তা মাথায় রেখে আমাদের এই (কঠোর না হওয়া) সিদ্ধান্ত।’অর্থের প্রতি সাকিব আল হাসানের দুর্দমনীয় টান।

এটা অন্যায় নয়। নিজের খ্যাতি বিক্রি করে বৈধ পথে অর্থ উপার্জনের অধিকার সবারই আছে। এবং সেটা যত ইচ্ছা তত। অনেকে বলেন, সাকিবের আর কত টাকা লাগবে? এটা আসলে সাকিব ঠিক করবেন, তার চাহিদার সঙ্গে অন্য কারও চাহিদা নাও মিলতে পারে। তিনি যত উপার্জন করতে পারবেন, সেটাই তার চাহিদা। অবসর নেয়ার আগেই সাকিব নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।একের পর এক ব্র্যান্ডের এ্যাম্বাসেডর হওয়া, বিজ্ঞাপনচিত্র করা তো আছেই কাঁকড়া ব্যবসা, হোটেল ব্যবসা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ই-কমার্স, স্বর্ণ ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, সব জায়গাতেই বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

ব্যাংকের লাইসেন্স চেয়েও পাননি। তবে অর্থ উপার্জনেরও কিছু নিয়ম-কানুন, নীতি নৈতিকতা আছে। সেটা না মানলেই সমস্যা। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার হিসেবে যে কোন ব্যবসা, বিজ্ঞাপন বা চুক্তি করার আগে বিসিবির অনুমতি নেয়া বা অন্তত অবহিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সাকিব কখনোই বোর্ডকে পাত্তা দেননি, ভবিষ্যতে দেবেন বলেও মনে হয় না!

Back to top button