দেশের বাজারে ডিমের দাম ইতিহাসে ‘সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে উঠেছে। একই সঙ্গে চড়া মুরগি ও গরুর মাংসের দাম। দুধের দামও বাড়তি। এ কারণে সীমিত আয়ের মানুষের নাগালছাড়া হয়ে যাচ্ছে প্রাণিজ আমিষ।ডিম পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি প্রাকৃতিক খাদ্য। একটি সেদ্ধ ডিম থেকে সাধারণত ৭৭ ক্যালরি পাওয়া যায়, যা দীর্ঘ সময় শক্তি জোগায়, ক্ষুধা কমায়।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার বাজারে ফার্মের মুরগির এক হালি বাদামি ডিমের দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এক মাস আগের তুলনায় এই দর ২৮ শতাংশ বেশি। এক বছর আগের তুলনায় তা ৫৪ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে দেশি হাঁস ও মুরগির ডিমের দর উঠেছে প্রতি হালি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ঢাকায় একটি ডিমের দাম ছিল ৭ টাকা। ২০২০ সালে এই দাম ৯ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।করোনাকালের শুরুতে অবশ্য ডিমের দাম ব্যাপক কমে গিয়েছিল। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
ওই বছর ২৬ মার্চ থেকে ঘোষণা করা হয় বিধিনিষেধ। তখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ৭০ টাকায় নেমে এসেছিল।দেশে গত মাসেও ডিমের হালি ছিল ৪০ টাকার নিচে। কিন্তু চলতি মাসে এসেই ডিমের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। এখন ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি হালি ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর দেশি মুরগি ও হাঁসের ডিমের হালি ৭০ টাকা।
ঢাকার বাজারে এখন এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার আশপাশে। টিসিবির হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় মুরগির দাম এখন ৫৬ শতাংশ বেশি। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে। গরুর মাংসের দাম এত বেশি যে সাধারণ মানুষ তা কিনতেই পারছে না।
ডিম, মুরগি ও গরুর মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নেওয়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দায়িত্ব।অধিদপ্তরের ভিশন বা রূপকল্পে বলা হয়েছে, ‘সকলের জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ’।
আর মিশন বা লক্ষ্যে বলা হয়েছে, ‘প্রাণিস্বাস্থ্য সেবা প্রদান, প্রাণীর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ’।চড়া দামের কারণে প্রাণিজ আমিষ যখন সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে, তখন অধিদপ্তর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে সংস্থার মহাপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, ‘এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছি যে দাম কী কারণে বাড়ছে।’
এর মধ্যে গতকাল প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। সভায় কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কাছে মুরগি ও ডিমের দাম কেন বেড়েছে, এর কারণ জানতে চেয়েছি।
তাঁরা বলেছেন, মুরগির বাচ্চার ঘাটতি ছিল, সে জন্য উৎপাদন কম হচ্ছে। খাদ্যের দাম বেশি। পরিবহন খরচও বেশি।’ তিনি দাবি করেন, ওই সভা চলার মধ্যে মুরগির দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা কমেছে। ডিমের দামও কমা শুরু হয়েছে। এ সপ্তাহে আরও কমবে।
দাম আসলে কমেছে কি না, জানতে চাইলে পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসীন বলেন, বুধবার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমেছে। আর ডিমের দাম কমেছে প্রতি হালি ৪ টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিস্থিতি মূল্যায়নে আগেই বৈঠক করা দরকার ছিল। তাহলে এভাবে দাম বাড়ত না।
পোলট্রি খাতে এখন কী সমস্যা চলছে, জানতে চাইলে আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান বলেন, আসল সংকট সরবরাহ কম। ডিমের উৎপাদন বেশি হলে দাম কমবে। যখন দাম কম ছিল, তখন খামারিরা যে মরে যাচ্ছিলেন, তার খোঁজ কেউ রাখেননি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয়বার বৈঠকে বসতে হবে। ছোট খামারি, বড় খামারি—সবার সঙ্গে বসতে হবে।
ডিমের দাম কেন এত বাড়ল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খামারিরা কয়েকটি কারণ সামনে আনছেন। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. মুরগির খাবারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। যে খাবারের প্রতি কেজির দাম ছিল ৩২ টাকা, তা এখন ৬২ টাকা। ২.গত কয়েক মাসে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ডিমের সরবরাহ কম।
৩. নতুন করে খামার চালু হচ্ছে। এতে এক দিন বয়সী বাচ্চার চাহিদা বেড়েছে। ফলে ডিমের একটা বড় অংশ যাচ্ছে বাচ্চা উৎপাদনে। পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ডিমের দাম শিগগির কমবে, এমন আশা কম।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে গতকাল ফেটে যাওয়া ডিম কিনছিলেন এক নারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নারী বলেন, তাঁর দুই সন্তান মাছ-মাংস ছাড়া খেতে চায় না। কিন্তু এখন চাল, ডালসহ মাছ-মাংসের দাম অনেক বেশি। ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকায় উঠেছে। তাই এখন তিনি মাছ-মাংস তেমন একটা কিনতে পারেন না।
প্রতিবেশীর কাছে শুনেছেন, কারওয়ান বাজারে ফাটা ডিম কম দামে পাওয়া যায়। তাই তা কিনতে এসেছেন।কারওয়ান বাজারে ডিমের দোকানে ফাটা ডিম এখন প্রতি হালি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে তা ২০ টাকা ছিল। ফাটা ডিমের মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ৩৮ শতাংশ।
পুষ্টিবিদদের মতে, একটি ডিমে প্রায় ৬ দশমিক ৩ গ্রাম উচ্চ মানের আমিষ, আয়রন, ভিটামিন এ-বি-ডি-ই এবং নতুন কোষ গঠনে সাহায্যকারী ফলেটের মতো পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় অনেকে ডিম খাওয়া ছেড়ে দেবেন কিংবা খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেবেন।