উৎপাদন ও রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কার আশঙ্কা

কিছুদিন আগে বাড়ানো হয়েছিল গ্যাসের দাম। শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার সূচি করে বিদ্যুতের লোডশেডিং করছে। এসবের প্রভাব পড়ছে দেশের উৎপাদন খাত ও রপ্তানি বাণিজ্যে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম যেভাবে বাড়ানো হলো, সেটি কল্পনাতেও ছিল না। সরকার আগ্রাসী ব্যবস্থার পথে হেঁটেছে। আমাদের ধারণা ছিল, ২০-২৫ শতাংশ দাম বাড়তে পারে। বাস্তবে যেটি করা হলো, সেটি কোনো হিসাবের সঙ্গে মিলছে না। এতে ছোট ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকারের এই সিদ্ধান্ত শিল্পখাতে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে।

এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় বাড়বে, পণ্যের দামও বাড়তে পারে। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আরও পিছিয়ে পড়বে এবং স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে দ্রুত দেশের বাজারেও জ্বালানির মূল্যহ্রাসের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন,  চলতি বছরের জুন মাসে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ৬ টাকা বৃদ্ধি এবং গত ৫ই আগস্ট কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলো।

নতুন করে লোডশেডিং সমন্বয়ে এলাকাভেদে সপ্তাহে একেক দিন একেক এলাকায় শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র মতো বড় সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিক কোনো নেতিবাচক মন্তব্য না করলেও অনেক ব্যবসায়ীই শঙ্কিত। উদ্যোক্তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত শিল্প কারখানার উৎপাদন হ্রাস ও রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। এই ধাক্কা জনগণের জীবনযাত্রার পাশাপাশি সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানির দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। এখন লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় অতিরিক্ত জ্বালানি লাগছে।এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দামের কারণে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাবে। এতে পুরো উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। এর প্রভাব পড়বে রপ্তানি বাণিজ্যে।

আকিজ ভেঞ্চার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ আলমগীর বলেন, শিল্প কারখানা একদিন বন্ধ থাকলে আমরা খুবই সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবো। এমনিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ডলারের ঊর্ধ্বমুখিতা এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শিল্পের অবস্থা ভঙ্গুর হয়েছে। তিনি বলেন, কারখানা যদি একদিন বন্ধ রাখা হয় তবে শ্রমিকের বেতন এবং অন্যান্য খরচ কমানো সম্ভব হবে না। কিন্তু সার্বিক উৎপাদন কমে যাবে। সেক্ষেত্রে কারখানা মালিকরা লোকসানের মধ্যে পড়বে।

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন। তার মতে, সপ্তাহে এমনিতেই একদিন শিল্পকারখানা বন্ধ থাকে। তার মানে এখন সাপ্তাহিক ছুটি আছে। এর আগেও এটা ছিল। সাধারণ ছুটি শুক্রবার। এতে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। এখন এটা জোনভিত্তিক করবে। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। এটা হয়তো জোনওয়াইজ বা এলাকাভিত্তিক করবে। হয়তো শুক্রবার সব খাতে ছিল। এখন হয়তো কোথাও মঙ্গলবার বা কোথাও শুক্রবার হবে। এতে কোনো সমস্যা হবে না।

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, সপ্তাহে একদিন কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পে একদিন কারখানা বন্ধ থাকলে যে ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। আর্থিক লস বাদেও পারিপার্শ্বিক ক্ষতি আরও বেশি। গার্মেন্ট সেক্টরে একেকটি সেকেন্ডের মূল্য রয়েছে। পুরো পোশাক শিল্প লিড টাইমের ওপর নির্ভর করে।

একদিন কারখানা বন্ধ থাকলে শিপমেন্টের দিকে পিছিয়ে যাবে। দৈনন্দিন ক্ষতি বাদেও বিলম্ব শিপমেন্টের কারণে বায়ারদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ডিসকাউন্ট বহন করতে হবে। এতে বায়াররা নিরুৎসাহিত হবেন। এজন্য ভবিষ্যতে তৈরি পোশাকের অর্ডারও কমে যেতে পারে। বহির্বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পরও আরএমজি (তৈরি পোশাক শিল্প) সেক্টরে রেশনিংয়ের কারণে অর্ডার বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে। এতে গার্মেন্ট সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সপ্তাহে একদিন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তা থেকে সরে আসা উচিত।

বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি মো. ওসমান গনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে সবার সংসারই একধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল। এখন রেস্তরাঁ ব্যবসার অস্তিত্ব নিয়ে ভাবছি। পকেটে টাকা না থাকলে মানুষ রেস্তরাঁয় খাবে না। মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এই ব্যবসা। এতে দাম সমন্বয় করে কয়টা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।

Exit mobile version