চাকরির শুরু থেকেই বিভিন্ন অপকর্মের হোতা কাজী আনারকলি
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে ফেরত নিয়ে আসা বাংলাদেশি কূটনীতিক কাজী আনারকলি তার বাসায় থাকা নাইজেরীয় যুবকের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতেন। অবশ্য একই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আগেও ছিল। শুধু তাই নয়, চাকরির শুরু থেকেই বিভিন্ন অপকর্ম করে বারবার পার পেয়ে গেছেন কাজী আনারকলি। এ কারণেই আজকে এমন অবস্থায় পড়তে হয়েছে বলে মনে করেন তার সহকর্মীরা।
গত জুলাইয়ে আনারকলি ও তার বন্ধু ইন্দোনেশীয় পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলে মন্ত্রণালয় কাজী আনারকলিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আফসোস করে বলেন, বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশ না হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়তো আবারও তাকে উচ্চতর কোনো পোস্টে বিদেশে পাঠাত, যেমনটি আগে হয়েছে।
তিনি বলেন, এ কথা সবাই জানে যে, মন্ত্রণালয়ে একটি সুবিধাভোগী দল রয়েছে এবং তারা অনেক অপকর্ম করেও পার পেয়ে যেতে পারছেন। এমনকি রাষ্ট্রদূতও হতে পেরেছেন। অথচ মন্ত্রণালয় অনেক যোগ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ক্ষুদ্র বা বিনাদোষে, শুধু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত রোষ বা ঈর্ষার কারণে পদোন্নতি ও প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং এমনকি চাকরিচ্যুতও করেছে। অনেক যোগ্য কর্মকর্তা ইতোমধ্যে চাকরি থেকে সরে গেছেন ও আরও অনেকে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছেন।
কাজী আনারকলি ২০০০ সালে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আবেদন করে চাকরি লাভ করেন এবং ক্ষমতার পালাবদলেও প্রতাপের সঙ্গে টিকে থাকেন। তিনি ২০০১-২০০৩ সালে মন্ত্রণালয়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সহকারী সচিব (রাষ্ট্রাচার ভ্রমণ) হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন এবং সে সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এডিসি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার হাসনাতের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
যদিও মন্ত্রণালয়ের সবাই এ অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতেন, ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সুপারিশে সিনিয়র অনেক কর্মকর্তাকে টপকিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনারকলিকে যুক্তরাজ্যে একটি স্কলারশিপ দেয়। এমন অবস্থায় আনারকলি তার স্বামী রেখে এবং তার প্রেমিক এডিসি হাসনাত তার স্ত্রী-সন্তান ও চাকরি রেখে একসঙ্গে লন্ডনে যান ও বিয়ে না করেই একসঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। পরে তারা বিয়ে করেছিলেন কি না জানা যায়নি, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনীতিকের স্বামী হিসেবে হাসনাতকে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করতে থাকে।
এসব ঘটনা জানা থাকলেও আনারকলির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা তো নেয়-ই নি, বরং পড়াশোনা শেষ করার পর তাকে হংকংয়ে ভাইস কনসাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে আনারকলি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে উপ-দূতাবাসেই হাতাহাতি, মারামারির ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় আনারকলির দ্বিতীয় স্বামী তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণভাবে আনারকলিকে দায়মুক্তি দিয়ে রোমে পোস্টিং দেয় ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শাস্তি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনে।
এর মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে আবারও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। সে সময় আনারকলির সঙ্গে বিএনপি সরকারের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এডিসি হাসনাতের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং ক্ষমতাসীন বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে আনারকলির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় নিজেকে ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী পরিচয় দিয়ে আনারকলি বিভিন্ন ছাত্রনেতা ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন।
ফলে ২০১২ সালে দেশে ফিরে এসে প্রায় দীর্ঘ চার বছর কাজী আনারকলি অত্যন্ত ক্ষমতাবান পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে কাজ করেন। সে সময় আনারকলির বিরুদ্ধে সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অযথা হয়রানি, ক্ষমতার অপব্যবহার, পোস্টিং প্রমোশনে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদির অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এগুলোতে মন্ত্রণালয় কান না দিয়ে ২০১৬ সালে কাজী আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যাঞ্জেলেসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়।
এ সময় তিনি একজন যুবক বয়সী পুরুষকে কাজের লোক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল একজন সিঙ্গেল নারী ও কন্যা সন্তানের মায়ের জন্য কোনো অনাত্মীয় যুবক বয়সী পুরুষকে তার ঘরের কাজের জন্য নিয়ে যাওয়াটা ও এক বাড়িতে থাকাটা স্বাভাবিক ও শোভনীয় কি না। কিন্তু ব্যক্তিগত এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্ণপাত করেনি।
আমেরিকায় যাওয়ার পর কাজী আনারকলির সঙ্গে একজন নাইজেরীয় যুবকের সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং বাংলাদেশি গৃহকর্মী যুবককে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন (২০১৭ সালে ) ওই যুবক স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নালিশ জানায় ও দাবি করে যে আমেরিকার ভিসার জন্য সে বিপুল পরিমাণ অর্থ আনারকলিকে দিয়েছে। এটি সরাসরি মানব পাচারের অভিযোগ।
সে সময় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনারকলিকে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে আমেরিকা থেকে সরিয়ে নেয় ও দ্রুত বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে। এত কিছুর পরও মন্ত্রণালয় কাজী আনারকলির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো দূরের কথা, বরং মাত্র ১৫ দিনের মাথায়, আগস্ট ২০১৭-তে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসে উপরাষ্ট্রদূত হিসেবে পোস্টিং দেয়।
আনারকলি সেখানে তার নাইজেরীয় বন্ধুকে নিয়ে যান এবং ২০১৭ থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত বিয়ে না করেই ওই নাইজেরীয় পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অর্থে দূতাবাসের বাসভবনে লিভ টুগেদার করতে থাকেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত, দূতাবাসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা অবগত থাকলেও কাজী আনারকলি নির্বিঘ্নে তা চালিয়ে যেতে পেরেছেন।