প্রতারণার মাধ্যমে স্ত্রীকে সৌদি আরবে পাচার, দেশে ফিরে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা
কথা ছিল স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিদেশ যাবেন। বিমানবন্দরে ঢুকে স্বামী স্ত্রীকে বললেন, তিনি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছেন। এই বলে বাইরে গিয়ে আর ফেরেননি। এদিকে দালালের মাধ্যমে স্ত্রী চলে যান সৌদি আরব। তখনো বুঝতে পারেননি তাঁর ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে!
সৌদি আরব যাওয়ার পর ওই নারীকে গৃহকর্মীর কাজে লাগানো হয়। চালানো হয় যৌন নির্যাতন। কয়েক বছর সৌদি আরবে থাকার পর গত বছর দেশে ফেরেন ওই নারী। এরপর মামলা করেন স্বামীর বিরুদ্ধে। গত বৃহস্পতিবার সে মামলার রায় দিয়েছেন রাজশাহীর মানবপাচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক।
স্ত্রীর ভাষ্য, ২০১৭ সালে তাঁর স্বামী বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তাঁকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলেন। নিজের পরিবারের সুখের কথা ভেবে তিনি তাঁর মায়ের জমি বন্ধক রেখে ও গরু বিক্রি করে স্বামীর হাতে ৪ লাখ টাকা তুলে দেন। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর স্বামী মাসুম পারভেজ তাঁকে বিমানবন্দরে ঢুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়েন।
ওই নারী বলেন, মাসুম কেটে পড়ার পর দালালদের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরব পৌঁছান। সেখানে তাঁকে গৃহকর্মীর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। বেতন স্বামীকে পাঠানো হচ্ছে বলে তিনি কিছুই পেতেন না। এ কাজে তাঁর আপত্তিও ছিল না। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর ওপর উপর্যুপরি যৌন নির্যাতন চালানো শুরু হয়। আপত্তি করলেই গৃহকর্তার নির্যাতন সহ্য করতে হতো।
রায়ে ওই নারীর স্বামী মাসুম পারভেজকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মাসুমের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার একটি গ্রামে। তিনি ঢাকায় রিকশা চালাতেন। আর তাঁর স্ত্রী কাজ করতেন পোশাক কারখানায়।
বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওই নারী। তখন তিনি জানতে পারেন তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। সে পক্ষে বাচ্চাও আছে। এসব জানার পরও ওই নারী মাসুমের সংসারে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন। তখন মাসুম তাঁকে তালাক দিতে বলেন।
না দিলে ওই নারীর বাবাকে হত্যার পাশাপাশি বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার হুমকি দেন। তখন বাধ্য হয়ে দেশে ফেরার আড়াই মাস পরে তিনি মাসুমকে তালাক দেন। এরপর উল্টো মাসুমই ওই নারীর বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রীকে আটকে রাখার অভিযোগ এনে মামলা করেন।
সৌদি আরবে পর্যায়ক্রমে তিনজন গৃহকর্তার বাড়িতে কাজ করতে হয় ওই নারীকে। প্রত্যেক বাড়িতেই একই ধরনের নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কয়েকবার স্বামীকে ফোন করে এসব জানিয়েছেন। সব শুনে তাঁর স্বামী বলেছেন, জেনেশুনেই তিনি তাঁকে সৌদি আরব পাঠিয়েছেন।
ওই নারী বলেন, কোনো উপায় না দেখে তিন বছর পর তিনি গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে স্থানীয় পুলিশের হাতে ধরা দেন। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি ২ মাস ১৬ দিন কারাগারে ছিলেন। এরই মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পান। বাবা-মা টাকা পাঠালে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন।
এই নারী বলেন, এত নির্যাতনের পরেও তিনি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাননি। কারণ তাঁর মেয়েটি শ্বশুর–শাশুড়ির কাছে আছে। এদিকে মাসুম মামলা করার পর তিনি আর থেমে থাকেননি। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনিও রাজশাহীর মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে মাসুম পারভেজ ও তাঁর ভগ্নিপতি জনাব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এই মামলা করার পর মাসুম তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। এতে ওই নারীকে বিদেশ পাঠানোর খরচ বাবদ ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দাবির পাশাপাশি নারীর বাবা-মাকে আসামি করা হয়। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে।
ভুক্তভোগী নারী বলেন, তাঁর প্রত্যাশা ছিল, এই অপরাধে মাসুম পারভেজের আরও বড় সাজা হবে। তার ভগ্নিপতিরও সাজা হবে। কিন্তু ভগ্নিপতি খালাস পেয়েছেন। তবে তাঁর আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেছেন, অপরাধ বড় হলেও মেয়েটির পক্ষে সাক্ষী পাওয়া যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর মানবপাচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক লিয়াকত আলী মোল্লা আসামি মাসুম পারভেজের তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। এ ছাড়াও রায়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এখন এই নারী বলছেন, আদালতে দেখা হলে মাসুম পারভেজ হুমকি দিয়ে বলেছেন, জেল থেকে বের হয়েই তাঁকে দেখে নেবেন। অন্য কোথাও বিয়ে করলেও সংসার করতে দেবেন না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। এখন বাবা-মায়ের সংসারে আছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল করবেন সে টাকাও নেই। তাঁর পাশে দাঁড়ানোরও কেউ নেই।