সেদিন ছিল ৪ এপ্রিল। ভোররাতে তৃতীয় রোজার সাহ্রি খাওয়ার কথা সবার। তাই রাত ১১টার মধ্যেই স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মো. আহসান উদ্দীন। পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন তাঁর ষাটোর্ধ্ব বাবা বজলুল হক সরকার। রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ তাঁদের ঘরের বাতি জ্বলে ওঠে।
মো. আহসান উদ্দীনদের বাড়ি ঢাকার যে জায়গায়, তার নাম ভাটুলিয়া। উত্তরখান থানার মধ্যে পড়া এই বাড়িই ঢাকা মহানগর পুলিশের আওতাধীন শেষ বাড়ি। বংশপরম্পরায় এখানেই থাকেন আহসানরা। কল্পনাও করেননি, এই বাসায় কেউ ঢুকে তাঁর বুকে পিস্তল, ঘাড়ে চাপাতি ধরতে পারে।
আহসান ও তাঁর স্ত্রী শান্তা আক্তার দেখেন, মুখে গামছা প্যাঁচানো পাঁচ-ছয়জন লোক তাঁদের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে ডাকাত দলটি শান্তা আক্তারের ওড়না দিয়ে আহসানের হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। তারপর একটা চাদর দিয়ে আহসানকে আপাদমস্তক ঢেকে দেয়।
আহসান বলেন, সোনার হার, চেইন, বালা, কানের দুল, নগদ ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা, ডিএসএলআর ক্যামেরা, বিছানার চাদর, কাপড়চোপড়—সব নিয়ে এবার ডাকাত দলটি তাঁদের ঘরে আটকে রেখে চলে যায়। তিনটি মুঠোফোনও নিয়ে যায়।
আহসান ও তাঁর স্ত্রী শান্তা আক্তার দেখেন, মুখে গামছা প্যাঁচানো পাঁচ-ছয়জন লোক তাঁদের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে ডাকাত দলটি শান্তা আক্তারের ওড়না দিয়ে আহসানের হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। তারপর একটা চাদর দিয়ে আহসানকে আপাদমস্তক ঢেকে দেয়।
আহসান বলেন, ‘এ সময় একজন ডাকাত বলে, ভাবি, আপনার শ্বশুরের টাকাটা বের করে দেন।’ শান্তা জবাবে বলেছিলেন, ‘যা আছে সব নিয়ে যান। কিন্তু পরিবারের কারও কোনো ক্ষতি কইরেন না।’ তখন একজন ডাকাত বলেন, তাঁরা মাল নিতে এসেছেন, কারও জান নিতে নয়।
এরপর আহসান ও শান্তাকে নিয়ে ডাকাত দলটি পাশে বজলুর রহমান সরকারের ঘরে ঢোকে। এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে তখনো ঘুমিয়ে। তাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু ডাকাত দল রাজি হয় না।
এদিকে রাতের বেলা এতজন অপরিচিত লোককে দেখে চমকে ওঠেন বজলুর রহমান সরকার। ডাকাত দল তাঁকেও আশ্বস্ত করে, তারা হত্যার উদ্দেশ্যে আসেনি। মালামাল নিয়েই চলে যাবে। পিছমোড়া করে বাঁধা আহসানের হাতে তখন অনেক মশা। ডাকাত দলের একজন যত্ন করে মশা তাড়াতে লাগলেন হঠাৎ।
ডাকাতেরা এই পর্যায়ে আহসান, তাঁর স্ত্রী শান্তা ও বাবা বজলুর রহমানকে একটি ঘরে রেখে বাইরে থেকে আটকে দিয়ে চলে যান। ততক্ষণে সাহ্রির সময় ঘনিয়ে এসেছে। আহসানরা এবার চিৎকার করতে শুরু করলেন। ভাটুলিয়ায় আহসানরা যেমন বংশপরম্পরায় আছেন, প্রতিবেশীরাও তেমনি এলাকার পুরোনো বাসিন্দা।
তাঁদের চিৎকার শুনে ছুটে আসেন আশপাশের লোকজন। তাঁরা আহসানদের বের করে আনেন।বজলুর রহমান সরকার ছাড়া পেয়েই মসজিদে চলে যান। তিনি মুয়াজ্জিনকে বলেন, তাঁদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল জানিয়ে মসজিদের মাইকে একটা ঘোষণা দিয়ে দিতে।
পরদিন আহসান উদ্দীন উত্তরখান থানায় মামলা করেন। মামলার দায়িত্ব দ্রুতই স্থানীয় থানা থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে যায়। মাঠে নামেন ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ কায়সার রিজভী কোরায়েশীসহ তাঁর সহকর্মীরা।
পুলিশ প্রথমেই তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। সে হিসেবে খোয়া যাওয়া মুঠোফোন উদ্ধারই ছিল তাদের প্রথম কাজ। খুঁজতে খুঁজতে মুঠোফোন তিনটি তারা পায় আহসানদের বাসার পেছনে কলার বাগানে। মুঠোফোনের অবস্থান শনাক্ত করে ডাকাত ধরার পরিকল্পনায় প্রথমেই হোঁচট খায় পুলিশ।
পুলিশ বলছে, এই পর্যায়ে তাদের দুটি চিন্তা মাথায় আসে। প্রথমত, ডাকাতি যাঁরা করেছেন, তাঁরা আহসানদের পরিচিত। ডাকাতেরা আহসানের স্ত্রীকে ভাবি বলে সম্বোধন করেছেন, আহসানের হাতে বসা মশা তাড়িয়েছেন আবার আহসানের বাবা বজলুর রহমান যখন আতঙ্কে কাঁপছিলেন, তাঁর গায়ে-মাথায় হাতও বুলিয়েছেন।
তা ছাড়া ডাকাতেরা আগে থেকেই জানতেন, শান্তার শ্বশুরের কাছে টাকা আছে।দ্বিতীয় যে চিন্তা নিয়ে এগোয় পুলিশ, তা হলো এই ডাকাতির সঙ্গে স্থানীয় কোনো বড় সন্ত্রাসীর যোগ আছে।খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, এই এলাকার উঠতি মাস্তান–পাতিমাস্তান, চোর, ডাকাত—সবাই চলেন এক ব্যক্তির কথায়। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ ওই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি।
সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই নাম আসে প্রতিবেশী হামিদের। অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা–দীক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও হামিদের বেশ ভালো যাতায়াত আছে আহসানদের বাড়িতে। হামিদের ভাবি ও আহসানের স্ত্রী শান্তা আক্তাররা আবার একই এলাকার বাসিন্দা।
তার চেয়েও বড় কথা, এলাকার সেই প্রভাবশালী সন্ত্রাসীর আত্মীয় হন হামিদ।ভাটুলিয়ার বাসায় হামিদ থাকেন তাঁর মায়ের সঙ্গে, স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছেন। নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। পুলিশি জেরাতেও কথা বলছেন উল্টাপাল্টা।
বজলুর রহমান সরকারের কাছে টাকা থাকার খবর বাইরের লোক জানল কী করে? আহসান বলেন, তাঁর বাবা দোকানে আড্ডা দিতে যান মাঝেমধ্যে। সেখানেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন কথাটা।পুলিশ জানায়, বজলুর শুধু টাকা আছে, তা-ই বলেননি। আরও বলেছেন, তাঁর প্রবাসী ছেলে ছয় লাখ টাকা পাঠিয়েছেন। বলেছেন, প্রতিদিন উত্তরায় গিয়ে নাশতা করতে। বাসায় একটা পাম্প বসাবেন বলে তিন লাখ টাকা রেখেছেন, বাকিটা ব্যাংকে আছে।
এবার একে একে স্থানীয় সেই বড় সন্ত্রাসীর সহযোগীদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল পুলিশ। এই দলে অতীতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এক আসামি আছেন। তিনি বললেন, ভাটুলিয়ার ডাকাতি তাঁরা করেননি। পুলিশও শেষ পর্যন্ত এই ডাকাতির সঙ্গে দলটির যুক্ততা পেল না।
ডাকাত দলের একজনের চেহারার কিছু অংশ মনে রেখেছিলেন আহসান। তাঁর চুল কাঁচা-পাকা, নাকের ওপরের অংশটা দাবানো, পায়ে ঘায়ের মতো আছে। স্থানীয় সোর্সকে কাজে লাগাল তারা।মোহাম্মদ কায়সার রিজভী কোরায়েশী বলেন, ‘সোর্স স্থানীয় ভাঙাড়ি দোকানভিত্তিক একটা ডাকাত দলের সন্ধান পায়। দেড় মাস হয়ে গেছে। ঠিক আস্থা পাচ্ছিলাম না, এই দলই সেটি কি না।’
পুলিশ সদস্যরা এবার বেশভূষা পরিবর্তন করে নতুন করে খুঁজতে শুরু করলেন এই দলের সম্পৃক্ততা। একজনের চেহারা মিলে যাওয়ার পর একে একে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা হলেন জাকির হোসেন, মো. সবুজ, মো. ওমর ও মো. ওসমান গণি (স্বপন)।
কিন্তু মুশকিল হলো, ডাকাতির কথা স্বীকার করলেও ডাকাত দল বলছে, তারা নিয়েছে দুটো চেইন, বাদী বলছেন তিনটি। তাহলে একটি গেল কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ওসমান গণি বলেন, চেইন আসলে তিনটিই। জাকির তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। তাঁকেই দিতে হয় লুণ্ঠিত জিনিসের বড় অংশ। তাই একটা চেইন নিজেই সরিয়ে রেখেছিলেন। এই দফায় তিনি পেয়েছেন ১৭ হাজার টাকা।আসামিদের রেকর্ড ঘেঁটে পুলিশ দেখতে পায়, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই একাধিক ডাকাতির মামলা আছে।
বাদী আহসান উদ্দীন বলেন, ডাকাত গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু নিজের বাড়িকে এত অনিরাপদ আর কখনো লাগেনি। রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাঁর বাবাও মাঝরাতে উঠে বসে থাকেন।