বহু হত্যাকাণ্ডের দায়ে খুলনা কারাগারে এরশাদ শিকদার নামে এক সন্ত্রাসীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয় ২০০৪ সালের ১০ই মে। তার আগে কয়েক বছর ধরে বেরিয়ে আসছিল তার হত্যা আর নির্যাতনের একের পর এক রোমহর্ষক কাহিনী। বাংলাদেশের সবচাইতে আলোচিত একজন ব্যক্তিতে পরিণত হন এরশাদ শিকদার। আর খুলনা শহরে তার প্রাসাদোপম বাড়িটি পরিণত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রস্থল।
এরশাদ শিকদার ১৯৭৭ সালের দিকে যখন খুলনার ঘাটে কুলি হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন, তখন তার ডাক নাম ছিল ‘রাঙ্গা চোর’।খুলনার একজন সাংবাদিক মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ‘খুলনার জল্লাদ: এরশাদ শিকদার’ নামে একটা বই লিখেছেন। এরশাদ শিকদারের ঘটনাপ্রবাহ সামনে আসার পর থেকে তার ফাঁসি হওয়া পর্যন্ত তাকে নিয়ে বহু রিপোর্ট করেছেন মি. তৈয়ব।
সেই সময় তিনি ঢাকার পত্রিকা মানবজমিনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিনিধি এবং স্থানীয় লোকসমাজ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান হিসাবে কাজ করতেন। এখন তিনি কাজ করেন বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে।
এরশাদ শিকদারের উত্থান হয়েছিল খুলনা ডকইয়ার্ডের একজন সাধারণ কুলি হিসাবে। পরবর্তীতে সেখানে তিনি ঘাট সর্দার বা কুলিদের সর্দার হয়ে উঠেন।এরপর ১৯৮২ সালে এইচএম এরশাদের সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন খুলনার আরেক এরশাদ শিকদার।
তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৪ জনকে হত্যার অভিযোগ ছিল। অনেককেই তিনি হত্যা করে মৃতদেহ গুম করে ফেলতেন। ফলে মৃতদেহও পাওয়া যেতো না, কোন মামলাও হতো না।এরশাদ সরকারের পর বিএনপি, এরপর আওয়ামী লীগ- কখনোই এরশাদ শিকদারের ক্ষমতায় ভাটা পড়েনি।
কিন্তু ১৯৯৯ সালে তার বিরুদ্ধে খুলনার একজন যুবলীগ নেতাকে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর দান উল্টে যায়। তার বিরুদ্ধে রাজস্বাক্ষী হয় তার নিজের দেহরক্ষী। সেই হত্যার অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটিতে, ১৯৬৭ সালে তিনি খুলনায় চলে যান। সেখানে রেলস্টেশনে কুলির কাজের পাশাপাশি রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করতেন। এই কারণেই তিনি ‘রাঙ্গা চোর’ হিসাবে পরিচিতি পান।সেই সময় তিনি একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে খুলনা রেল স্টেশন, চার ও পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
২০০০ সালের ৩০শে এপ্রিল এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে খুলনার আদালত।তবে আপিল এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার পর্ব পার হয়ে সেই ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৪ সালের ১০ই মে।সেই সময় খুলনার কারাগারের কর্মকর্তাদের সহায়তায় একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে প্রবেশ করেছিলেন সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু। বর্তমানে তিনি ডিবিসি নিউজের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ”কারাগারে আমার পরিচিত কর্মকর্তাদের সহায়তায় একজন কর্মীর ছদ্মবেশে আমি কারাগারে ঢুকি। কারণ এরশাদ শিকদারের ফাঁসির ব্যাপারে সারা দেশের মানুষের একটা আগ্রহ ছিল। সেই ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলাম।” রাত ১২টা এক মিনিটে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতার পর জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এরশাদ শিকদার। তাদের প্রশ্রয়ে এরশাদ শিকদার খুলনার ঘাট দখল করে সাম্রাজ্য তৈরি করতে শুরু করে। সেই সরকারে প্রশ্রয়েই তার উত্থান হতে শুরু করে।সেই সময় খুলনার জাহাজের ঘাটে তিন-চার হাজার শ্রমিক করতো। এদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন এরশাদ শিকদার।
জাতীয় পার্টির সভা-সমাবেশে ঘাট থেকে তিনি শ্রমিকদের কর্মী হিসাবে সরবরাহ করতো।তাৎক্ষণিকভাবে সে ৩/৪ হাজার মানুষ যোগাড় করে ফেলতে পারতো। এই কারণে রাজনৈতিক দলে তার কদর ছিল। এরশাদ সরকারের সময়েও সে সেটা পেয়েছে, পরে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও সেই সুবিধা পেয়েছে। ফলে সে নিজে তো বটেই, অন্যরাও মনে করতে শুরু করেছিল যে, এরশাদ শিকদার সব আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
১৯৮৮ সালে খুলনার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনারও নির্বাচিত হন এরশাদ শিকদার। ফাঁসীতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন তিনি।কিন্তু কমিশনার হওয়ার পর তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থামেনি।রেলওয়ের সম্পত্তি দখল করা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল করা, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য অপরাধে তিনি জড়িয়ে পড়েন।
তখন খুলনার বাণিজ্যিক এলাকা ছিল সাত ও চার নম্বর ঘাট এলাকা। কিন্তু শুধুমাত্র একটা লোকের অত্যাচারে এই ঘাট স্থানান্তরিত হয়ে নোয়াপাড়ায় চলে যায়।এইচএম এরশাদের পতনের পর বিএনপিতে যোগ দেন এরশাদ শিকদার। আবার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেয়।
নিজের এতো অপরাধের মধ্যেও এরশাদ শিকদারকে গ্রেপ্তার হতে হয়নি।খুলনার কেন্দ্রস্থলে স্বর্ণকমল নাম একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন এরশাদ শিকদার, যেটিও তার নির্যাতনের অন্যতম কেন্দ্র বলে মনে করা হতো।সেই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্রও উদ্ধার করেছিল পুলিশ।
এরশাদ শিকদারের ঘটনাপ্রবাহ সামনে আসার পর এই স্বর্ণকমল নামের বাড়িটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়।আজো বহু মানুষ খুলনা গেলে শহরের অভিজাত এলাকা সোনাডাঙ্গা রোডের এই বাড়িটির সামনে একবার ঢুঁ মারতে ভোলে না।
এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে ২৪টি হত্যাকাণ্ড করার সাক্ষ্য দিয়েছেন তার দেহরক্ষী। কিন্তু তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এরশাদ শিকদার ৬০টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে তার ধারণা।এসব মৃতদেহ বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেয়া হতো অথবা ইটের ভাটায় পুড়িয়ে ফেলা হতো।
কিন্তু যুবলীগ নেতা খালিদ হোসেনের হত্যাকাণ্ড তাকে টেনে নিয়ে যায় ফাঁসির কাষ্ঠে।১৯৯৯ সালের ১১ই অগাস্ট চার নম্বর ঘাট এলাকায় গিয়েছিলেন যুবলীগ নেতা খালিদ হোসেন, ব্যবসায়ী সৈয়দ মনিরসহ চারজন।তাদের ওপর হামলা করে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে খালিদ হোসেনকে হত্যার পর বস্তায় ভরে সংলগ্ন ভৈরব নদে ফেলে দেয়া হয়।
মৃতদেহের সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেল এবং প্রাইভেট কারও ফেলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে খালিদ হোসেনের মৃতদেহ পাওয়া যায়।সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এরশাদ শিকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু মামলায় কোন সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছিল না।সেই সময় খুলনার কমিশনার ছিলেন আনোয়ারুল ইকবাল। তিনি ওই সময়ে বলেছিলেন, সাংবাদিকরা এতো অপরাধের কথা লিখছো, কিন্তু আমি তো কোন সাক্ষী পাই না।”
তখন এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দেহরক্ষী নূরে আলম।পুলিশ তদন্তে নেমে একজন আইনজীবীর সহায়তায় আদালতে দায়ের করা আরও তিনটি মামলার সন্ধান পায়।এর মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয় এরশাদ শিকদারকে।
এরপর এরশাদ শিকদারকে গ্রেপ্তারে অভিযাগ শুরু করা হলেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখনকার আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্বাসে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে আত্মসমপর্ণ করে এরশাদ শিকদার। তার ধারণা ছিল, কিছুদিন পরেই আবার জামিনে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সেই যে কারাগারে ঢুকলো, এরপর একেবারে ফাঁসির পর লাশ হয়ে তাকে বের হতে হয়েছে।বিচার চলার সময় তার নামে ৪৩টি মামলা হয়েছিল। তার মধ্যে সাতটি মামলায় তার ফাঁসি হয়।