পারিবারিক সম্মতিতে প্রায় চার মাস আগে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল। হঠাৎ করেই আঁখি (ছদ্মনাম) স্বামীর ঘরে যেতে বেঁকে বসেন। এ নিয়ে সালিশ বৈঠক শুরু হয়। সেই বৈঠকে ছেলের পক্ষ বিয়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করে।মেয়ের পরিবার বিয়ের আয়োজনে ছেলেপক্ষের যে খরচ হয়েছে তা ফেরত দিতে না পারায় বড়বোনের স্বামীর ঘরে ছোটো বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন সালিশদাররা।
জানা গেছে, লাথারকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আঁখি। তার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী স্বরূপকাঠি উপজেলার শাহাদত হোসেন ওরফে উকিলের ছেলে সৈকতের (১৯) বিয়ে হয়। কিছুদিন পূর্বে সৈকতের স্ত্রী আঁখি তার বাবার বাড়িতে চলে যান। এভাবে প্রায় চারমাস আঁখি তার বাবার বাড়িতে অবস্থান করে আসছিলেন।
ঘটনাটি ঘটেছে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার হারতা ইউনিয়নের লাথারকান্দি গ্রামে। চলতি বছরের ২৩ মে এ ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটলেও সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়। জানাজানির পর এ নিয়ে হারতা ইউনিয়নের লাথারকান্দি গ্রামে এবং স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউপির ডুবি গ্রামে শোরগোল পড়েছে।
এদিকে, তথ্য নিতে ছেলের বাড়িতে হাজির হওয়ার পরপরই তার বর্তমান স্ত্রী সপ্তম শ্রেণীপড়ুয়া শিক্ষার্থীকে নাজিরপুর উপজেলার কলারদোনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এমএলএসএস মোজাম্মেলের বাসায় দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে কথা হয় লাথারকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ আলী ব্যাপারী বাড়ির সালিশদার রুহুলের সাথে। তিনি বলেন, মেয়ের বাবা ও মায়ের কাছে সকলের সামনে ছেলের বাবা ও ভগ্নীপতি দাবি করেন- টাকা দাও, না হয় মেয়ে দাও। এ ব্যাপারটি আমার ভালো না লাগায় আমি ওই বৈঠক থেকে রাত ৯টার দিকে চলে আসি। তারপর শুনেছি, ছোট মেয়েকে ওই বাড়ি থেকে স্বরূপকাঠী নিয়ে গেছেন তারা।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আরেক সালিশদার হুমায়ুনের স্ত্রী লুৎফা বেগম। তিনি বলেন, ছেলের বাবা শাহাদত ও বোনজামাই মো. হাচান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তারা সকলের উপস্থিতিতে বৈঠকে সৈকতের বিয়েবাবদ খরচ দাবি করেন। একপর্যায়ে তারা বলেন, যদি সৈকতের বিয়েবাবদ খরচ হওয়া টাকা না দেন তাহলে ছোটো মেয়েকে সৈকতের বউ হিসাবে দিয়া দেন।
একই কথা বারবারই বলেছিলেন সৈকতের বাবা শাহাদত। আমি এমন সিদ্ধান্তে রাজি হতে না পেরে চলে আসি। লুৎফা আরো বলেন, ওখানে একই গ্রামের মোবারেক ডাকুয়া সালিশদার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আমরা চলে আসলেও পরে জানতে পারি, ওনাদের দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় সোমবার সকালে শাহাদত ও হাচান ক্লাস সেভেনপড়ুয়া ছোট মেয়েকে বউ করে স্বরূপকাঠি নিয়া গেছে।
চলতি বছরের ২২ মে সৈকতের বাবা তার ছেলের স্ত্রী আঁখিকে আনতে লাথারকান্দি বেয়াই বাড়িতে যান। তার সঙ্গে সৈকতের ভগ্নীপতি হাচান ছিলেন। আঁখি তাদের সঙ্গে স্বামীর বাড়িতে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এমনকি আর কোনদিন যাবেন না বলে শ্বশুরকে জানিয়ে দেন।
তখন সৈকতের বাবা ছেলের বিয়েতে যে টাকা খরচ হয়েছে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে তা দাবি করে বসেন। তখন আঁখিদের বাড়িতে ওই রাতেই স্থানীয়দের সমন্বয়ে এ নিয়ে সালিশ বৈঠক শুরু হয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলে সেই বৈঠক। এসময় মেয়ের বাবা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তখন সৈকতের বাবা শাহাদত হোসেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে আঁখির ছোটবোনকে সৈকতের সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তখন উপস্থিত সালিশদাররা এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তখন আঁখির ছোটবোন ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। পরদিন ২৩ মে সকালে সালিশদারদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ছোটবোনকে স্বরূপকাঠিতে সৈকতের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
সৈকতের বাবা শাহাদত হোসেন মুঠোফোনে বলেন, সকলের সামনে ৪ মাস পূর্বে ছেলের বিয়েবাবদ খরচ হওয়া টাকা চাই। অথবা ছেলেকে পুনরায় বিয়ে দিয়ে দেওয়ার দাবি করি মেয়ের পরিবারের কাছে। এসময় মেয়ের বাবা টাকা দিতে অপারগ হলে আমরা ছোটো মেয়েকে সৈকতের সাথে বিয়ে দেওয়ার দাবি করি। তখন উপস্থিত সালিশদাররা আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়। পরদিন সকালে সালিশদারদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ছোটো মেয়েকে নিয়ে স্বরূপকাঠি আমাদের বাড়িতে চলে আসি।
সৈকতের মা বলেন, ছেলের বৌকে আনতে তার স্বামী শাহাদত হোসেন লাথারকান্দি বেয়াই বাড়িতে যায়। কিন্তু ছেলের বৌকে নয়, তার ছোট বোনকে নিয়ে আসে। পরের দিন আমার স্বামী ও মেয়ে জামাই লাথারকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছোটো বোনকে সৈকতের বউ হিসাবে নিয়ে আসেন।
আঁখির বাবা-মা বলেন, ছেলের বাবার দাবি অনুসারে টাকা দিতে পারলে ছোট মেয়েকে ওখানে পাঠিয়ে দেওয়ার দরকার হতো না। আমরা গরীব মানুষ, টাকা দিতে হলে আমার ঘর বিক্রি করতে হবে। তাই বসতঘর হারানোর ভয়ে টাকার পরিবর্তে ছোট মেয়েকে সৈকতের বউ হিসাবে পাঠিয়ে দেই।
সৈকতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নাজিরপুর উপজেলা কলারদোনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পিয়ন মোজাম্মেলের বাসায় অবস্থান করছেন সৈকতের শ্যালিকা।
মোজাম্মেলের মুঠোফোনের মাধ্যমে কথা হয় ওই শিক্ষার্থীর সাথে। শিশুটি এ প্রতিনিধিকে বলে, আব্বা-আম্মা আমাকে দুলাভাই সৈকতের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে। সে অনুযায়ী সৈকতের আব্বার সাথে আমাকে দুলাভাই বাড়িতে পাঠায়। এ বাড়িতে এসে জানতে পারি আমার বড়বোন সৈকতের সাথে সংসার করবে না। এজন্য আমারে সৈকতের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজি এখনো বিয়ে পরানয়নি, কারণ আমার বয়স হয়নি।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৩ মে ছোটবোনকে বউ করে নিয়ে আসলেও বড় বোনের সাথে তালাক হয় ২৫ মে বিকেলে। তালাকনামা লেখা কাজি হারতা ইউপির সত্তার মিয়া বলেন, ২৫ তারিখে তালাকনামা আমার অফিসে বসে লেখা হয়। ছোটবোনের বয়স না হওয়ায় আমি বিয়ে পড়াবো না বলে দিয়েছি।