‘এক টানে, দুই টানে কিছু হয় না। ’ কখনো বন্ধু, কখনো বড় ভাইদের ডাকে সাড়া দিয়ে মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুধু মাদক সেবনে থেমে নেই, অনেকে কারবারিতেও নাম লেখাচ্ছেন। ঘটছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনাও।পাঠাতে হচ্ছে নিরাময় কেন্দ্রে। ফিরে এসেও আবার তারা পুরনো আসরে। পরিস্থিতি এমন যে, মাদকই খেয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীদের।
অতিরিক্ত মাদক সেবনে অসুস্থ বা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বঙ্গবন্ধু হলের পুকুরপাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে নেশা করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আশিকুর রহমান কোরাইশি নামের এক শিক্ষার্থী। পরে সেই অবস্থায় বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এর আগে গত জানুয়ারিতে মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের দস্তগীর হোসেন। পরে তার পরিবারকে ডেকে শিক্ষকদের সহায়তায় ঠাকুরগাঁওয়ের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ঈদের ছুটির পর ক্যাম্পাসে ফিরে দস্তগীর আবারও মাদকে জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানান তার বন্ধুরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নিয়মিত মাদক সেবন করে। ক্যাম্পাসে, এমনকি নিজ কক্ষে বসেই তারা মাদকদ্রব্য পেয়ে যাচ্ছেন। বহিরাগত কিছু মাদক কারবারি বিভিন্ন ছদ্মবেশে ক্যাম্পাসে এসে কতিপয় শিক্ষার্থীর কাছে সরবরাহ করছেন।
তাদের মাধ্যমে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে মাদকসেবীদের হাতে। গত বুধবার রাতে ক্যাম্পাস গেট থেকে আনোয়ার জোয়ার্দার নামের এক কারবারিকে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এমন স্থানীয় অনেক মাদক কারবারি ছদ্মবেশে বা ঘুরতে এসে সরবরাহ করছেন মাদক।
ক্যাম্পাসে মাদকের ছড়াছড়ির জন্য আবাসিক হলগুলোতে প্রভোস্ট বা তার সহকারী শিক্ষকদের অনুপস্থিতি অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে সব কিছু ‘জেনেও’ প্রশাসনের নিশ্চুপ থাকায় বাড়ছে মাদক। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করছে না কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে মাদক সেবক এবং কারবারিদের ‘নিরাপত্তার চাদরে’ ঢেকে রাখেন সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতারা। মাদক নিয়ে ধরা পড়লেও ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ পরিচয়ে পার পেয়ে যান তারা। দলে নবীন কর্মীদের অন্তর্ভুক্তির জন্য মাদককে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করছেন ছাত্রলীগের উপশাখার বড় ভাইয়েরা।
মাদক থেকে ফিরে আসা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘খুব ইনটেনশনালি মাদক সরবরাহ করা হয়। আল্লাহ আমাকে হেফাজত করেছে। আমি সেখান থেকে ফিরে এসেছি। যারা এটা করে তারা নতুন প্রজন্মকে মেধশূন্য করতে চায়। ’
ছেলেদের প্রতিটি হলেই নিয়মিত বসে মাদকের আসর। গরমের কারণে এখন আবাসিক হলের ছাদকে বেছে নিয়েছে মাদকসেবীরা। এর মধ্যে মাদকের আখড়া হিসেবে পরিণত হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল। এই হলের ন্যাশনাল অংশের (দেশীয় শিক্ষার্থীদের জন্য) প্রথম ব্লকের দ্বিতীয় ও চতুর্থ তলার একাধিক রুম, দ্বিতীয় ব্লকের দ্বিতীয় তলার একটি রুম, চতুর্থ ব্লকের তিন তলার একটি রুমে বসে মাদকের আসর।
ইন্টারন্যাশনাল অংশেরও একাধিক রুমে নিয়মিত মাদক সেবন করেন শিক্ষার্থীরা। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় বহিরাগতরা। আসরে জুয়াও খেলা হয়। শেখ রাসেল হলের একাধিক রুমেও আড্ডা দেয় মাদকসেবীরা। জিয়াউর রহমান হলের দক্ষিণ ব্লকের চতুর্থ তলার একটি রুম এবং উত্তর ব্লকের চতুর্থ তলার তিনটি রুমে আসর বসে বলে জানিয়েছে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া সাদ্দাম হোসেন হল লালন শাহ হলেও বসে মাদকের আড্ডা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর ঘাট, ফুটবল ও ক্রিকেট মাঠে, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধসহ একাধিক স্থানে আসর বসান শিক্ষার্থীরা।এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শেলিনা নাসরিন বলেন, ‘এটা সামাজিক অবক্ষয়। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও গাফিলতি আছে। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে কমানো যায়। প্রয়োজনে সচেতনতামূলক প্রগ্রাম বৃদ্ধি করব এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ’
ক্যম্পাসে সবচেয়ে সহজলভ্য মাদক গাঁজা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাঁজার ডিলার বিএনসিসি অফিসের এক কর্মকর্তা। তাকে একাধিকবার মাদকসহ আটক করলেও অদৃশ্য জোরে ছাড়া পেয়ে যান। ওই কর্মকর্তার হয়ে ক্যাম্পাসে গাঁজার ডিলার হিসেবে কাজ করেন স্থানীয় শিপন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ৪/৫ জনকে গাঁজা দিয়ে রাখেন তিনি।
বড় অর্ডার থাকলে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে আনতে হয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়াবা ঢোকে রাতে। স্থানীয় দুই কারবারির মাধ্যমে ইয়াবা ছড়ায় পুরো ক্যাম্পাসে। যার মধ্যে একজন প্রায়ই আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে। সেখান থেকে বণ্টন হয় ইয়াবা। অন্যজন গত বুধবার গ্রেপ্তার আনোয়ার জোয়ার্দার।
এ ছাড়াও জরুরি ভিত্তিতে ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী শেখপাড়া বাজারের ‘মেথরপট্টি’ থেকে ইয়াবা আনেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে পাহাড়ি মদ আসে ক্যাম্পাসে। যা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কিছু শিক্ষার্থীর মাধ্যমে আসে। আগে পাহাড়ি জেলা থেকে মদ আনা হলেও এখন নেওয়া হয় ঢাকার শ্যাওড়াপাড়া থেকে।
এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে মাদক ঢোকার বিষয় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদেরকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রভোস্টদের মাধ্যমে আবাসিক হলগুলোতে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে দেখা যায় জড়িতরা শিক্ষার্থী, তখন কিছু শিক্ষার্থীই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার পুলিশকে দায়িত্ব দিলেও ভিন্ন রকম হয়ে যায়। আমরা শিক্ষকরা ছাত্রদের বুঝিয়ে সচেতন করা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি? তবুও প্রক্টর ও প্রশাসনের আরো যারা আছেন, তাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলব। ’