ইয়াবা গডফাদার নুরুল হক হত্যার জেরে অশান্ত হয়ে উঠেছে টেকনাফের তিন গ্রাম

টেকনাফ পৌর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ দিকে তিন কিলোমিটার গেলে সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি গ্রাম নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া ও হাবির পাড়া। নাফ নদীর তীরের এই তিনটি গ্রাম ‘ইয়াবাগ্রাম’ হিসেবে পরিচিত।

গ্রাম তিনটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আছেন প্রায় ৮০০ জন। টেকনাফে তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী ৯৯১ জন। এর মধ্যে ‘গডফাদার’ ৭৩ জন। এর মধ্যে সম্প্রতি গডফাদার নুরুল হক ওরফে ভুট্টুকে (৩৪) হত্যা করা হয়েছে। এর জেরে অশান্ত হয়ে উঠেছে ওই জনপদ।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টেকনাফ ব্যাটালিয়নের একজন কর্মকর্তা বলেন, তিনটি গ্রামে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বাস। তাঁদের ৮০ শতাংশের পেশা কৃষি ও মৎস্য আহরণ পেশায় জড়িত। এর মধ্যে নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের ইয়াবার বড় বড় চালান আনা হয় নাজিরপাড়া ও মৌলভী পাড়ায়। গত তিন বছরে এই দুই গ্রাম থেকে ইয়াবার অন্তত ৩০টি বড় চালান জব্দ করা হয়। ইয়াবা কারবারিদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকায় সাধারণ মানুষ মুখ খোলার সাহস পান না।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ১৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ‘গডফাদার’ ও নাজিরপাড়ার বাসিন্দা নুরুল হককে কুপিয়ে হত্যা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত আরেক ইয়াবা ‘গডফাদার’ মোহাম্মদ একরামের (৩০) নেতৃত্বে ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি একরাম।

মামলার পর থেকে প্রায় প্রতি রাতে একাধিক ব্যক্তির বাসাবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। হামলার আশঙ্কায় অনেক নারী–পুরুষ আত্মগোপনে চলে গেছেন। যাদের বাড়িতে এসব হামলা হচ্ছে তাঁরা বেশির ভাগই একরামের অনুসারী।

নাজিরপাড়ায় বুধবার সকালে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়ি পুরুষশূন্য। দক্ষিণের মৌলভীপাড়াতেও একই অবস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, নুরুল হককে হত্যার পর এলাকার মানুষ আতঙ্কে সময় পার করছেন।

আগে ইয়াবার বড় বড় চালান খালাস হলেও ওই হত্যাকাণ্ডের পর তা বন্ধ আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় মাদক কারবারিরাও এলাকাছাড়া। তবে রাতের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে লোকজনের বাসাবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে।

আত্মগোপনে থাকা কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার শিকার নুরুল হকের মামাতো ভাই ৮ নম্বর ইউপি সদস্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ‘গডফাদার’ এনামুল হক। হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই প্রতিশোধ নিতে এনামুলের নেতৃত্বে অধিকাংশ লোকজনের বাসাবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হচ্ছে।

তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করছেন এনামুল হকের লোকজন। তাঁদের দাবি, নুরুল হক হত্যা হামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে প্রধান আসামি একরাম নিজের লোকজনকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে লোকজনের ঘরবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালাচ্ছেন।

১৭ মে রাত ১১টার দিকে মৌলভীপাড়ার মো. আমিনের বাড়িতে হামলা ও মালামাল লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আমিনের স্ত্রী সনজিদা বেগম টেকনাফ মডেল থানায় ইউপি সদস্য এনামুল হকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। সনজিদা বলেন, থানায় অভিযোগ করায় এনামুল ক্ষুব্ধ হয়ে ২১ ও ২২ মে রাতে দুই দফায় তাঁর বসতবাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় হামলাকারীরা ঘরের আসবাব, টিভি, ফ্রিজ, ঘরে রাখা গাছের সুপারিসহ অন্যান্য মাল লুট করে। প্রাণনাশের হুমকির পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

দুর্বৃত্তের হামলায় ১৮ মে আহত হন নাজিরপাড়ার জাফর আহমদ। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মহানগরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। ওই সময় লুট করা হয় জাফর আহমদের পালিত তিনটি গরু। একই দিন স্থানীয় আবু বক্কর, হাজি জমিলের বসতঘর ভাঙচুর ও মালামাল লুট করা হয়।

২২ মে বিকেলে নাজিরপাড়ার রবিউল আলম, বদিউল আলম ও ফরিদ আলমের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় ফরিদ আলমের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমকে বেদম মারধর করা হয়। আনোয়ারা এখন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

২২ মে রাতে একদল দুর্বৃত্ত নাজিরপাড়ার মো. ছলিমের বসতবাড়িতে হামলা চালায়। দুর্বৃত্তরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ছলিমকে মারধর করে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বাঁধা দিলে তাঁর স্ত্রীসহ ঘরের লোকজনকেও মারধর করা হয়। লুট করা হয় ঘরের মালামাল। ঘটনার পরদিন ছলিমের স্ত্রী রুজিনা আক্তার বাদী হয়ে টেকনাফ মডেল থানায় এনামুল হকসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। রুজিনা বলেন, এখনো তাঁর স্বামীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

হামলা ভাঙচুর ও লুটপাতে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে ইউপি সদস্য এনামুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নুরুল হক হত্যা মামলা ভিন্ন খাতে নিতে মামলার আসামিসহ একটি চক্র তাঁর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা রটাচ্ছে। মূলত এই হত্যাকাণ্ডের পর আসামিপক্ষ তাঁকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়, সেই চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রশাসন ও সংবাদিকদের বিভ্রান্ত করতে তাঁর (এনামুল হক) বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মিথ্যা মামলার অভিযোগ করা হচ্ছে।

গত আট দিনে তিন গ্রামে অন্তত ২১টি বাড়িতে এ ধরনের হামলা হয়েছে। অধিকাংশ হামলায় এনামুলকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। গত ইউপি নির্বাচনে এনামুল হকের সঙ্গে একরামের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। নুরুল হক হত্যা মামলায় একরামকে প্রধান আসামি করায় এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল হক হত্যাকাণ্ডের জের ধরে এলাকায় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে নজরদারি বাড়িয়েছে। নুরুল হত্যা মামলার এজাহারনামীয় চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বসতবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের পৃথক চারটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। চারটি অভিযোগেই ইউপি সদস্য এনামুল হককে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ তদন্তের পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

টেকনাফে দুই দফায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১২১ জন ইয়াবা ‘গডফাদার’ ও ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করলেও ব্যবসা বন্ধ হয়নি বলে জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টেকনাফ শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এ পর্যন্ত টেকনাফে প্রায় ২০০ জন নিহত হলেও মাদক চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং চোরাচালান বেড়েছে। মাদকের টাকা ভাগাভাগি, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় কারবারিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রমশ বাড়ছে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে মাদকবিরোধী এক সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন এনামুল হক, মোহাম্মদ একরামসহ ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। তখন ইয়াবা মামলায় কারাগারে ছিলেন নুরুল হক। প্রায় দুই বছর কারাগারে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসেন আত্মসমর্পণকারীরা।

Exit mobile version