সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে নারায়ণগঞ্জের ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার
সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে নারায়ণগঞ্জের ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার। চলতি মাসেই এক স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার মতো নির্মম ঘটনার ক্ষত না শুকাতেই আবারও নির্মমতার শিকার হয়েছেন সুব্রত মণ্ডল নামের একজন হোসিয়ারি শ্রমিক।
স্থানীয়রা জানান, নারায়ণগঞ্জে এখন আতঙ্কের নাম ‘কিশোর গ্যাং’। এমন কোনো উপজেলা নেই, এমন কোনো ইউনিয়ন নেই, যেখানে ‘কিশোর গ্যাং’ নেই। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীর প্রতি পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং এখন যেন এক ‘বিষফোঁড়া’। ধনীর দুলাল থেকে শুরু করে হতদরিদ্র পরিবারের উঠতি বয়সের কিশোরাও জড়িয়ে পড়েছে এই গ্যাংয়ে।
এমনকি স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বাদ যাচ্ছে না এই গ্যাং থেকে। পাড়া মহল্লায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে এই ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ নেপথ্যে ছত্রছায়ার কাজটি করছে ওই এলাকার রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালীরা। গত ৩ বছরে পুরো জেলায় এই ‘কিশোর গ্যাং’ ইস্যুতে খুনের মতো ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে দেড় ডজন।
গত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জয়ী কাউন্সিলরের পক্ষে কাজ না করায় রাতভর নির্যাতন করা হয় হোসিয়ারি শ্রমিককে। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর আগে বলে যাওয়া সেই নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে আঁতকে উঠেছেন সবাই। গত ১৫ মে নগরীর দেওভোগ জিউস পুকুর পাড় এলাকায় নিজ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে রাতভর তাকে নির্যাতন করা হয়। এরপর ২২ মে সুব্রত মারা যান। নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক অসচেতনতা, প্রভাবশালীদের আশ্রয় আর দারিদ্র্যের কারণেই বেড়ে চলেছে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ আধিপত্য। গত ১৭ মে ফতুল্লার ইসদাইর এলাকায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে খুন হন দশম শ্রেণির ছাত্র দ্রুব দাস। হত্যার সঙ্গে জড়িতরাও স্কুল পড়ুয়া, যারা এই গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ছিল। গত ২ মাসেই পৃথক ঘটনায় ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ হামলায় দশম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রসহ ৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, আক্রমণের শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীসহ বহু মানুষ।
গত ৩ এপ্রিল নগরীর জামতলা কেন্দ্রীয় ঈদগাহর সামনে ‘কিশোর গ্যাং’-এর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজের ছেলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহমেদ অন্তর। গত ১৩ মে রাতে নগরের গলাচিপা বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক অগ্রবাণী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রশিদ চৌধুরী ও পথচারী মো. জসিম।
গত ৬ এপ্রিল বুধবার সকালে ফতুল্লার ইসদাইর বাজার এলাকায় শামীম নামের এক যুবককে ডেকে এনে প্রকাশ্যেই কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। খুনের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ কিশোর। ২৫ এপ্রিল ফতুল্লার মাসদাইর শেরেবাংলা সড়কে এক গার্মেন্টস শ্রমিককে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
আহত গণমাধ্যমকর্মী রশিদ চৌধুরীর ভাষ্য, বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো অস্ত্র হাতে মহড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক দিন আগে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে তাদের পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। এর জের ধরে তার ওপর হামলা হয়েছে বলে তার ধারণা।
গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জেরে মো. ইমন নামে একজন যুবককে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ২৯ জুন চাষাঢ়ায় রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকাতে মাদকের স্পট নিয়ে বিরোধে ২ কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে নিহত হন রাজমিস্ত্রি রুবেল। এর আগে ২০২০ সালের ১০ আগস্ট বন্দরের ইস্পাহানী ঘাট এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষ চলার সময় এক পক্ষের ধাওয়ায় আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা যায় দুই শিক্ষার্থী মিহাদ ও জিসান।
২০১৯ সালের ২৭ জুলাই ফতুল্লার দেওভোগ হাশেম নগর এলাকায় মোটরসাইকেলের লাইটের আলো চোখে পড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাকিলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরেরই ৩১ জুলাই ফয়সাল নামে এক কিশোর শহরের খানপুর বরফকল এলাকায় বান্ধবীর মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দিতে গেলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে পাঁচ কিশোর।
এদিকে, গত ১৪ মে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর থানা এলাকায় ৩টি হামলা হয়। এসব হামলায় ফতুল্লার দেওভোগ পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় মিরাজুল ইসলাম দিপু, সিদ্ধিরগঞ্জে কলেজ শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিয়াদ ও বন্দরে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম রিফাত ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন।
নারায়ণগঞ্জ তোলারাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দর্শন বিভাগের প্রধান জীবন কৃষ্ণ মোদক বলেন, ‘মূলত পঞ্চায়েতভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে লোপ পাওয়ায় সামাজিক বন্ধন, আচার-আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে, যা এসব অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। পারিবারিক সচেতনতা ও পঞ্চায়েতভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে এসব সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি।’
এ ব্যাপারে জেলার প্রবীণ গণমাধ্যমকর্মী হাবিবুর রহমান বাদল জানান, মূলত স্থানীয় প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়েই মূলত বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। কারণ একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রাথমিকভাবে বড় অপকর্ম করার সাহস থাকে না। কিন্তু প্রভাবশালী নেতারা যখন তাদের কাজকর্ম করার জন্য গ্যাংদের আশ্রয় দিয়ে থাকে, তখন সেসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আর এভাবে গ্যাংগুলো মারাত্মক অপকর্ম করে থাকে।
‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. জয়েদুল আলম বলেন, ‘অভিভাবকদের অনুরোধ করবো, তারা যেন সন্তানদের সন্ধ্যার পর কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যেতে না দেন। সব ঘটনাতেই পুলিশের সতর্ক নজরদারি রয়েছে।’ কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান বিষয়ে কোনো খবর থাকলে তা পুলিশকে জানাতে তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান।