কখনো মার্কিন নাগরিক। কখনো কানাডিয়ান নাগরিকের পরিচয় দিতেন। টার্গেট বিদেশে পিএইচডি ও উচ্চশিক্ষারত কম বয়সী শিক্ষার্থী ও যুবক। যাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতীয়সহ কানাডা আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী প্রবাসী। ভিন্ন ভিন্ন তিন কণ্ঠস্বরে কখনো নিজেকে পাত্রীর মা, বোন এবং পাত্রী সেজে কথা বলেন।
ম্যারেজ মিডিয়ায় ভুয়া আইডি খুলে ভুয়া মার্কিন নাগরিকত্ব সনদ, ড্রাইভিং সনদ দিয়ে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেন। বিয়ের পর তাদের এসব উন্নত দেশগুলোতে স্বামী হিসেবে নিয়ে স্থায়ী নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দেন।
সম্পর্কের একপর্যায়ে বিয়ের জন্য দামি স্বর্ণের আংটি, কাজীর খরচ এবং বিয়ের বাজার করার অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেন যোগাযোগ। আর এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত পুরো পরিবার। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে যাওয়া পাবনার এক যুবক ওই প্রতারক পরিবারের কাছে প্রতারণার শিকার হন।
সম্প্রতি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে গেছেন পাবনার এক শিক্ষার্থী। পড়ালেখা শেষে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের উপায় হিসেবে সুমির প্রতারণার ফাঁদে পা দেন তিনি। গত ঈদের আগে শাদি ডটকমে বিজ্ঞাপন দেখে সুমির সঙ্গে আলাপ হয় তার। এ সময় ভিডিও কলে ফেসফিল্টার ব্যবহার করে কখনো পাত্রী, কখনো পাত্রীর বোন এবং মা সেজে ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠ ব্যবহার করে কথা বলেছেন সুমি।
নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে পরিচয় দেন। সুমির প্রেমে যখন মগ্ন ওই যুবক ঠিক তখনই বিয়ের জন্য স্বর্ণের আংটি, দামি লেহেঙ্গা বিয়ের কাজীর খরচসহ অর্থ পাঠাতে বলেন। সুমির কথা অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে সে আমেরিকা থেকে সুমির স্বামীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাঠান।
এ সময় বাংলাদেশে এসে দান খয়রাত করতে গিয়ে সুমির সকল অর্থ শেষ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিমানের টিকিট পাঠাতে বলেন। বিমানের টিকিটের কথা শুনে সন্দেহ হয় যুক্তরাষ্ট্র্রের শিক্ষার্থীর। পরবর্তীতে গুলশান থানায় বাদী হয়ে সম্প্রতি সুমি এবং তার প্রতারক পরিবারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় মামলা করলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ প্রতারণায় যুক্ত ওই পরিবারের অন্যতম সদস্য এবং কথিত পাত্রী সুমি ও তার সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য।
মহানগর গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরো নাম শায়লা শিরিন সুমি। বয়স ৪৫ বছর। অষ্টম শ্রেণি পাস। ছিলেন গার্মেন্টকর্মী। স্বামী মাসুদুর রহমান। বড় বোন শায়লা শারমিন। বসবাস করেন পুরান ঢাকার আরমানিটোলায়। তাদের প্রত্যেকের পেশা প্রতারণা।
গত প্রায় এক দশক ধরে প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত এই পরিবার। তিন বছর আগে প্রতারক সুমির হাতে খড়ি হয় তার বড় বোন শায়লা শারমিনের মাধ্যমে। শায়লা রাতারাতি বড়লোক হতে তিন বছর আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিজস্ব ওয়েবসাইট শাদি ডটকমে ভুয়া পরিচয়ে সুমিকে পাত্রী সাজিয়ে একটি আইডি খুলে দেন।
সেখানে নিজেকে কখনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক পরিচয় দিয়ে পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দেন। স্বামী মারা যাওয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করে দ্বিতীয় স্বামীকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। প্রতারক সুমি বাংলা, আরবি, উর্দু এবং ইংরেজিসহ একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতসহ একাধিক দেশের প্রায় অর্ধশত প্রবাসী সুমির প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। প্রতারণার অংশ হিসেবে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজিতে মেসেজ লিখে দিতেন সুমির স্বামী মাসুদুর।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সুমির স্বামীর নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে ডলার, পাউন্ডসহ বিভিন্ন সময়ে অর্থ এসেছে। এদের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশের প্রায় ১০ জন, ভারতের ১০ জন, পাকিস্তানসহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর প্রায় অর্ধশত যুবক সুমির প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
তাদের কাছ থেকে কখনো, ১০ হাজার ডলার, কখনো পাঁচ হাজার পাউন্ড এভাবে বিভিন্ন সময় অর্থ হাতিয়ে নিয়ে তাদের আইডি ব্লক করে দিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন প্রতারক সুমি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ওয়ারী) উপ- কমিশনার আশরাফ হোসেন বলেন, সম্প্রতি গুলশান থানায় মামলা হলে তদন্তে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত সুমিকে তার এক সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
প্রতারক সুমির মোবাইলফোনে প্রতারণার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে চক্রের সঙ্গে আরও কেউ যুক্ত আছে কিনা তাদেরকে খুঁজে বের করতে কাজ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন সামাজিক ওয়েবসাইটে যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিজ্ঞাপন দেখে বিয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নিতে পরামর্শ দেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।