বাংলাদেশে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত পি কে হালদারের পশ্চিমবঙ্গে ১১টি বাড়ি, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে ইডি। তাঁর আরও অনেক সম্পদ পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। তাই পি কে হালদারকে সঙ্গে নিয়ে বাকি সম্পদের সন্ধানে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।
পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) কাছে ভারতীয় পরিচয়পত্রের পাশাপাশি তিন দেশের পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশ গ্রেনাডা। ভারতের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ইডির কর্মকর্তারা মনে করছেন, হালদারের অর্থের একটা বড় অংশ এখনো দুবাইয়ে রয়েছে। হাওয়ালা (হুন্ডি) নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দুবাই এবং পশ্চিমবঙ্গ দুই জায়গাতেই অর্থ পাঠানো হয়েছে।জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন পি কে হালদার। এটি জানাজানির পর ২০১৯ সালের শেষ দিকে তিনি দেশ ছেড়ে পালান। আর ভারতে সম্পদ কেনাও শুরু করেছিলেন ২০১৯ সালে।
ইডি গত শনিবার পি কে হালদারসহ যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে, গতকাল রোববার তাঁদের নাম প্রকাশ করেছে। গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছেন প্রাণেশ কুমার হালদার, যিনি উত্তর চব্বিশ পরগনায় পি কে হালদারের জমিজমা, বাড়ি ও মাছের ভেড়ির ব্যবসা আংশিকভাবে দেখাশোনা করতেন।
প্রাণেশ পি কে হালদারের আত্মীয়। আরেকজন আছেন স্বপন মৈত্র ওরফে স্বপন মিস্ত্রি, যিনি হাওয়ালার মাধ্যমে পি কে হালদারের টাকা ভারতে আনার ব্যাপারে সহায়তা করেছিলেন। এ ছাড়া রয়েছেন উত্তম মৈত্র ওরফে উত্তম মিস্ত্রি, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার ও আমানা সুলতানা ওরফে শর্মি হালদার।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ইডির একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, গ্রেপ্তার ছয়জনই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বিভিন্ন পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তারা ভারতে একাধিক কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা করছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে জমি, বাড়ি ও মাছের ভেড়ি (বড় পুকুর বা দিঘি) কিনেছিলেন।
এঁদের মধ্যে পুরুষ পাঁচজনকে ২০০২-এর মানি লন্ডারিং আইন সম্পর্কিত বিশেষ আদালতের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ মে পর্যন্ত হেফাজতে নিয়েছে ইডি। আমানা সুলতানাকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে (জেলে) রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কয়েক দিনের মধ্যেই এই মামলার তদন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) হাতে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এই মামলার ব্যাপকতা, ‘ক্রস বর্ডার ইমপ্লিকেশন’ (সীমান্তের দুই পারে অপরাধ) এবং বিপুল অর্থ পাচারের কারণে বৃহত্তর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
পি কে হালদারসহ পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে ইডি-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, পি কে হালদার ২০১৯ সালের আগেই আত্মীয় ও সহযোগীদের অনেককে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা জমিজমা এবং মাছের ভেড়ি কিনতে শুরু করেন। তাঁদের প্রধান সুকুমার মৃধা।
তিনি বাংলাদেশে পি কে হালদারের আয়কর আইনজীবী। সুকুমার উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় ব্যবসায়ী, জমির দালাল ও মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তদন্তকারীদের কাছে এখনো এটা স্পষ্ট নয় যে সুকুমার নিজেই এই নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন নাকি অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে পি কে হালদারই তাঁকে দিয়ে ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক তৈরি করিয়েছিলেন।
ভারতের বিভিন্ন সূত্র বলছে, পি কে হালদারের বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা চলছিল বলে মনে করা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে অপরাধমূলক তথ্যের আদান-প্রদানবিষয়ক যে প্রটোকল রয়েছে, তা ব্যবহার করে এটা করা হয়েছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে ইডি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু বলেনি। বাংলাদেশ সরকারকেও এই গ্রেপ্তারের বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকার কিছু জানায়নি।পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পি কে হালদার ও সুকুমার মৃধার লোকজনের যে একটা যোগাযোগ ছিল, সেটাও এখন মোটামুটি স্পষ্ট বলে এখানকার তদন্তকারীরা মনে করছেন। সুকুমার মৃধা বর্তমানে বাংলাদেশের কারাগারে আছেন।