বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে পিয়নের কাজ করেন শফিকুর রহমান। তার বেতন ১৫ হাজার টাকা। কাজীপাড়ায় একটি বাসায় স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে সাবলেট থাকেন। ৪ হাজার টাকা ঘরভাড়া ও ১০ হাজার টাকায় বাজার করেন। সাইকেল চালিয়ে অফিসে যান। বাকি টাকা হাতখরচের।
তিনি বলেন, ‘ভাত-ভাজি ভর্তা খেয়েই দিন পার করছি। আমার ছোট বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে হয়। কিন্তু দুধের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে দুশ্চিন্তায় আছি। নিজেরা কম খেতে পারি কিন্তু বাচ্চার খাওয়া তো আর কমাতে পারি না। সঞ্চয় বলতেও তেমন কিছু নেই। অনেকটা ‘দিন আনি দিন খাই’-এর মতো জীবন পার করছি।’
মিরপুরের বাসিন্দা কাশেম আলী। সিএনজিচালিত এ অটোরিকশা চালকের মাসিক আয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। ৭ হাজার টাকা ঘরভাড়া আর ১৫ হাজার টাকা তার খরচ হয় মাসের বাজারে। বাকি ৩ হাজার টাকা দুই সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে খরচ করেন। কোনো মাসে ধার করে সংসার চালান কাশেম। তিনি জানান, আগে সপ্তাহে ১ লিটার সয়াবিন তেলে তার পরিবারের রান্নার কাজ চালালেও দাম বাড়ায় এখন আধা লিটার তেল কিনছেন।
মাসে বড়জোর একবার গরুর মাংস খাওয়ার সামর্থ্য আছে কাশেমের। আগে যেখানে দৈনিক তিন চার পদের শাক-সবজি ও মাছ খেতেন, এখন দু-এক তরকারি খেয়েই তার পরিবারের দিন কাটছে। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাইড়া যাওয়ায় আগের তুলনায় অর্ধেক বাজার করতাছি। তাও টাকা হাতে রাখতে পারতাছি না।’
বাজারে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাজারে শাক-সবজি কেনার পর অনেকেরই আর মাছ-মাংস কেনার টাকা থাকছে না। কেনার সামর্থ্য না থাকায় অনেকে শুধু দরদাম করেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
গত এক বছরের ব্যবধানে সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১০৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৮ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে ৯৩ টাকা। প্রতি কেজি চিনি গড়ে ৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা। চিনিতে বেড়েছে ২২ টাকা। বিভিন্ন রকম সাবান গড়ে ৪ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আটা, ময়দা কেজি প্রতি বেড়েছে ৮ থেকে ২০ টাকা।
সরিষার তেল লিটারে ৮০ টাকা বেড়েছে। মসুরের ডাল প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪০ টাকা। বেড়েছে পিঁয়াজের দামও। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও পাড়া-মহল্লার দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি পিঁয়াজের দাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় উঠেছে।
ঈদের আগে গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। যা এক মাস আগেও ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ টাকা ছিল। কিন্তু ঈদের পরও এখন মাংস ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের মতো দাম বাড়ছে শিশুখাদ্যেরও। এর মধ্যে তরল দুধ, গুঁড়া দুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট, কর্নফ্লেক্স রয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির গুঁড়া দুধের কেজি এখন ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে দাম বেড়েছে ডিমেরও। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের আমিষের ঘাটতি পূরণই হয় ডিমের মাধ্যমে। অথচ দাম বেড়ে এখন ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন ১২৬ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় নিম্ন মধ্যবিত্তের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারও এবার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনা শুরু করেছেন। ঈদের আগে গত ২৪ এপ্রিল থেকে ডিলারদের মাধ্যমে ট্রাকে করে এই পণ্য বিক্রি বন্ধ থাকলেও আগামী ১৫ বা ১৬ মে থেকে এই পণ্য বিক্রি আবার শুরু হতে পারে।
শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, যানবাহনের অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝাও বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এখন স্বল্প দূরত্বে যেতেও রিকশা চালকরা ভাড়া ৩০ টাকার নিচে নিতে চান না। সিএনজিচালিত অটোরিকশায়ও দুই-আড়াই শ টাকার নিচে ভাড়া নেই।
এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বছর বছর বাড়ছে। উন্নত এলাকাগুলোতে ঘরভাড়া এতই বেশি যে অনেকের আয়ের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়ার পেছনে। এ জন্য স্বল্প আয়ের মানুষ এখন অনুন্নত এলাকায় ঘর খুঁজছে। কেউ কেউ করোনাকালীন পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকায় আর ফিরিয়ে আনেননি। পরিবারের কর্মক্ষম পুরুষটি একাই একটি রুম ভাড়া করে বা মেসে থাকছেন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গোটা পৃথিবীজুড়েই এখন মুদ্রাস্ফীতি চলছে। আর এই চাপ যে শুধু বাংলাদেশে তা নয়। অনেক পণ্যই আমরা আমদানিনির্ভর। বিদেশে যখন সেই পণ্যের দাম বাড়ে তখন দেশেও তার প্রভাব পড়ে।
কিন্তু সাধারণ মানুষ, যাদের নির্দিষ্ট আয় তাদের আয় বাড়ছে না। আয় না বাড়ায় এ মানুষগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলো আর কিনছেন না। শিক্ষা, বিনোদন এসব খাতে ব্যয় কমাচ্ছেন। আবার অনেকের ধারকর্জ বাড়ছে। সার্বিকভাবে বলা যায় ভোক্তারা কষ্টে আছেন। দিন দিন এই কষ্ট বাড়ছে।
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন সরকারকে তা করতে হবে। মানুষের যাতে আয় রোজগার ও কর্মসংস্থান বাড়ে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এ জন্য কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধানের উৎপাদন যাতে বাড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।