নিউমার্কেট সংঘর্ষে নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা, জড়িত দুজনকে শনাক্ত
নিউমার্কেট এলাকায় গত মঙ্গলবার সংঘর্ষের সময় কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত দুজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। দুজনই ঢাকা কলেজের ছাত্র। থাকেন কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসে। একজনের নাম কাইয়ুম, অন্যজনের নাম বলতে চায়নি পুলিশ।
দুজনেই ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির একজন নেতার অনুসারী। সংঘর্ষের ঘটনায় সংগ্রহ করা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে।
ডিবি বলছে, নাহিদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হেলমেটধারী এবং হেলমেট ছাড়া একাধিক ব্যক্তি কুপিয়েছেন। এর মধ্যে একজনের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যাঁর ছবি গণমাধ্যমে এসেছে, তাঁর পরিচয় সম্পর্কে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে দুজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে, যাঁদের একজন সেই অস্ত্রধারী হতে পারেন।
এ ছাড়া ধারালো অস্ত্র হাতে গত মঙ্গলবার রাস্তায় যাঁদের দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে আরও দুজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাঁরাও ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র ও হেলমেট পরে ঢাকা কলেজের যেসব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির চার নেতার অনুসারীরা বেশি সক্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে নাহিদ হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসীম উদ্দিন ও নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী ফিরোজ হোসেনের অনুসারী।
নাহিদকে কোপানোর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের একজন ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের ২০১ নম্বর কক্ষে থাকেন বলে নিশ্চিত হয়েছেন ডিবি কর্মকর্তারা। সেই কক্ষে জসীম উদ্দিনের অনুসারীরাও থাকেন বলে ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, ২০১ নম্বর কক্ষে একাধিক গ্রুপের ছাত্ররা থাকে।
জসীম উদ্দিন গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ভিডিওতে যাঁদের দেখা গেছে, তাঁদের তিনি চেনেন না। ঘটনার দিন (মঙ্গলবার)পরিস্থিতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া কাইয়ুম সম্পর্কে তিনি বলেন, কাইয়ুমকে কলেজের ছাত্রাবাসে দেখেছেন। অন্য গ্রুপের রাজনীতি করেন কাইয়ুম। তবে ছাত্রলীগের কোন নেতার অনুসারী কাইয়ুম, সেটা তিনি নিশ্চিত নন।
ধারালো অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষ ও হামলায় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের অংশ নেওয়ার বিষয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে গতকাল রাতে মুঠোফোনে কয়েক দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাঁরা কেউ ফোন ধরেননি।
পরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, ধারালো অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের কাউকে সংঘর্ষে–হামলায় দেখা যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। তদন্তে যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাঁদের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সাংগঠনিকভাবেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত সোমবার রাতে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। নিউমার্কেটের দুটি খাবারের দোকানের দুই কর্মীর বিতণ্ডা থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত। এর জের ধরে মঙ্গলবার দিনভর রাজধানীর মিরপুর সড়কের নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন বিপণিবিতানের দোকানমালিক-কর্মচারী ও হকারদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন দুজন। আহত হয়েছেন অর্ধশত।
এদিকে মঙ্গলবারের সংঘর্ষে নিহত দুজনের মধ্যে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেন হত্যা মামলার তদন্ত করছে ডিবি। অন্যদিকে নিহত দোকানকর্মী মোহাম্মদ মুরসালিন হত্যা মামলার ছায়া তদন্ত করছে সংস্থাটি। এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব নিউমার্কেট থানা-পুলিশের কাছে থাকলেও এটিও ডিবিতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, নাহিদ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ভিডিও ফুটেজে যাঁদের দেখা যাচ্ছে, তাঁদের বিষয়ে একেকজন একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে ডিবি।
ডিবি সূত্র বলছে, ধারালো অস্ত্র নিয়ে যাঁরা মঙ্গলবার ভাঙচুর ও সংঘর্ষে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা মূলত ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ ওরফে জুলফিকার, সদস্য শফিক আহমেদ, জসীম উদ্দিন ও শাহীন সাদেক মীর্জার অনুসারী। তাঁরা সবাই সেদিন সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে ডিবি জানিয়েছে। এর মধ্যে শাহীনকে ধারালো অস্ত্র হাতে দেখা গেছে।
সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেননি সামাদ আজাদ। তবে তাঁর দাবি, সেদিন ছাত্রদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে তা সম্ভব হয়নি।সংঘর্ষের বিষয়ে কলেজের নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী ফিরোজ হোসেনের দাবি, তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন না।
গতকাল পত্রিকায় ছাপা হওয়া অস্ত্রধারীদের মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁদের একজন ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শাহীন সাদেক মীর্জা। তাঁর বাড়ি বরিশালে। তিনি কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসে ২১৮ নম্বর কক্ষে থাকেন। অন্যজন হলেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা কাউসার হামিদ ওরফে সাদা কাউসার।
ধারালো অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িত থাকার বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে শাহীন সাদেক মীর্জা গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘যে ছবি ছাপা হয়েছে, সেটি আমার ছবি হলে তো লুকানোর কিছু নেই।’ পরক্ষণেই তিনি আবার বলেন, ছাপা হওয়া ছবি তাঁর নয়। আর কাউসার হামিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ডিবির একটি সূত্র বলছে, সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং হামলায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সদস্য শফিক আহমেদের অনুসারীরা বেশি বেপরোয়া ছিলেন।এ বিষয়ে শফিক আহমেদ বলেন, সংঘর্ষের সময় শুধু তাঁর অনুসারীরা নয়, অনেকের অনুসারীরাই অংশ নিয়েছেন।
তবে মুরসালিন হত্যায় তাঁর অনুসারীরা জড়িত ছিলেন কি না, এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে এবং ধারালো অস্ত্র হাতে ব্যবসায়ী-দোকানকর্মী যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে।