অপরাধএক্সক্লুসিভচট্টগ্রামবাংলাদেশব্রাহ্মণবাড়িয়া

সরাইলে পুলিশি হেফাজতে এক ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এক ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে কি না, উঠছে সে প্রশ্নও। নিহত নজির আহমেদ উপজেলা সদরের নিজসরাইল গ্রামের হাফেজ উবায়েদ উল্লাহর ছেলে। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই একটি হত্যা মামলা করেছেন। এই মামলায় ১৩ আসামির মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নিহত নজিরের স্বজনদের বরাতে পুলিশ জানায়, পূর্ববিরোধের জেরে জুম্মান গত বৃহস্পতিবার দিনভর নজির ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের গালমন্দ করে নানাভাবে নাজেহাল করার চেষ্টা চালান। রাত সাড়ে নয়টার দিকে জুম্মান নজিরের বসতবাড়ির প্রধান ফটক অতিক্রম করে শয়নকক্ষে ঢুকে পড়েন। এ সময় নজিরের লোকজন তাঁকে কক্ষে আটকে মারধর করে গুরুতর আহত করেন। রাত ১০টার দিকে পুলিশ জুম্মানকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসা হয় নজিরকেও।

মামলার এজাহার ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সূত্রে জানা যায়, বসতবাড়ির জায়গা নিয়ে কয়েক বছর ধরে নজির আহমেদের সঙ্গে প্রতিবেশী জুম্মান মিয়ার বিরোধ চলে আসছিল। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মামলাও হয়েছে। গ্রামে দফায় দফায় সালিসও হয়েছে। জুম্মান এলাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত।

তাঁর অসহযোগিতার কারণে ওই বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। সম্প্রতি জুম্মান মিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোশায়েদ উল্লাহসহ আশপাশের গ্রামের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিরোধকে আরও ঘোলাটে করে তোলেন।

পুলিশের ভাষ্য, থানায় আনার পর জুম্মানকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। তাঁর সঙ্গে পাঠানো হয় নজিরকেও। এর মধ্যে অসুস্থ বোধ করতে থাকেন নজির। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। তবে নজিরের স্বজনদের ভাষ্য, থানায় যাওয়ার সময় পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন নজির। তাঁর জটিল কোনো শারীরিক সমস্যাও ছিল না। পুলিশি হেফাজতে এমন কী হলো, যার কারণে নজিরের মৃত্যু হয়েছে।

ঘটনার রাতেই গ্রামের ইউপি সদস্য মোশায়েদ উল্লাহকে প্রধান আসামি করে ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন নজিরের আরেক ভাই ও কলেজ শিক্ষক জাফর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের বুকের নিচে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। আমি মনে করি, আমার সুস্থ ভাই এমনিতেই মারা যায়নি। এখানে কোনো ঘটনা ঘটেছে।’উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা নোমান মিয়া বলেন, নজিরকে হাসপাতালের বিছানায় শোয়ানোর পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত পান।

সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম হোসেন বলেন, ‘মারধরের শিকার জুম্মান খুব অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একই সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে জুম্মানের সঙ্গে নজিরকেও আমরা থানা থেকে হাসপাতালে (দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার) পাঠিয়েছিলাম। কারণ, অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে একজন পাবলিককেও যেতে হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর নজির বুকে ব্যথা অনুভব করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’

আহত জুম্মানের চিকিৎসার জন্য তাঁর পরিবারের কাউকে কেন আনা হয়নি, এমন প্রশ্নে আসলাম হোসেন বলেন, জুম্মানের আগের রেকর্ড খারাপ, একটু বখাটে প্রকৃতির। তাঁর সঙ্গে আনার জন্য তাঁর পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। সে জন্য জুম্মানের সঙ্গে নজিরকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।

নজির পুলিশি হেফাজতে মারা গেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, নজির আহমেদ পুলিশি হেফাজতে মারা যাননি। তিনি থানায় এসেছিলেন বাদী হিসেবে। কারণ, নজিরের পরিবারের লোকজন দাবি করেছিলেন, চুরি করতে তাঁদের ঘরে প্রবেশ করেছিলেন জুম্মান। এ জন্য তাঁকে আটক করেছিলেন তাঁরা।

তবে পুলিশের এসব যুক্তি মানতে নারাজ নিহত নজিরের বড় ভাই বাংলাদেশ জাসদ একাংশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হুসাইন আহমেদ।তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে সুস্থ অবস্থায় থানায় নেওয়া হলো। ফিরিয়ে দেওয়া হলো লাশ করে। এখানে পুলিশের কাছে থাকার সময়ে অবশ্যই একটা কিছু হয়েছে। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চাই।’

ঘটনার পর থেকে মামলার প্রধান আসামি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোশায়েদ উল্লাহ গা ঢাকা দিয়েছেন। একাধিকবার তাঁর মুঠোফোনে চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। অন্য আসামিরাও পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) বলেন, নজির আহমেদের দুই ভাই থানায় উপস্থিত হয়ে মামলা করেছেন।

থানায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, নজির সুস্থ দেহে স্বেচ্ছায় থানায় প্রবেশ করেছেন এবং বের হয়ে গেছেন। তাঁকে পুলিশের কোনো সদস্য কিছু বলেননি। থানা থেকে বের হয়ে পরে অসুস্থ বোধ করেছেন। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, শুক্রবার দুপুরে জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে নজিরের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। আর তাঁর ভাইদের করা হত্যা মামলায় জুম্মানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

Back to top button