মিডিয়া ব্র্যান্ডের ২০টি এসি বিক্রি করে টাকা না পেয়ে এখন রাঙামাটির পথে পথে ঘুরছেন ঢাকার এক এসি ব্যবসায়ী। এসি বিক্রির সাত লাখ ৪৬ হাজার টাকার মধ্যে অগ্রিম পাওয়া এক লাখ টাকা ছাড়া বাকি টাকা না পেয়ে রাঙামাটি এসে বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে বুধবার রাতে রাঙামাটির কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দেন হান্নান মিয়া নামের ওই ব্যবসায়ী।
হান্নান মিয়া বলেন, সম্প্রতি বিক্রয় ডট কমের মাধ্যমে শাহীন নামের এক ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের জন্য মাওরুম ট্রেডার্সের মাধ্যমে ২০টি এসি সরবরাহ করতে বলেন। তারপর মহসিন ও শাহীনের সঙ্গে দফায় দফায় কথার মাধ্যমে আমি এক লাখ টাকা অগ্রিম নিয়ে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’তে প্রথম দফায় ৯টি এবং দ্বিতীয় দফায় ১১টি এসি সরবরাহ করার কাজ নিই।
কথা ছিল মালামাল রাঙামাটি পৌঁছলে আমাকে নগদে টাকা পরিশোধ করা হবে। কিন্তু ১৭ এপ্রিল প্রথম দফায় মিডিয়া ব্র্যান্ডের ৯টি এসি রাঙামাটি পৌঁছলে ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন সেই এসিগুলো রিসিভ করেন এবং বাকি এসিগুলো পাওয়ার পর টাকা শোধ করবেন বলে জানান। ফলে পরদিনই আমি বাকি ১১টি এসি পাঠাই।
কিন্তু এসিগুলো রাঙামাটি আসার পর তাঁরা জোরপূর্বক সেগুলো নামিয়ে রাখলেও টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং আমাকে চেনে না বলে জানায়। একই সঙ্গে টাকার বিষয়ে মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
অভিযোগে রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুল জব্বার সুজন, রাঙামাটি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহসিনুর রহমান এবং শাহীন হায়দার নামে ঢাকার এক ব্যবসায়ীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।সাকিরা ইলেকট্রনিকস নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. হান্নান মিয়া জানান, তিনি ঢাকার মিরপুরে সাকিরা ইলেকট্রনিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং মূলত এসি ব্যবসা করেন।
তিনি আরো জানান, কিন্তু শাহীন আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন যে মালামাল রাঙামাটি পৌঁছলে নগদেই পার্টি (সুজন) পরিশোধ করবেন। অথচ এখন আমার টাকা না দিয়ে টালবাহানা করছেন তাঁরা। গত দুই দিন আমি রাঙামাটির বিভিন্নজনের কাছে গেছি। সবার সহযোগিতা চেয়েছি। জানি না আমি আমার টাকা পাব কি না।
যোগাযোগ করা হলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহসিনুর রহমান বলেন, ‘এসি আমি অর্ডার করেছি এটা সত্য এবং এসিগুলো আমি সুজনের কাছে বিক্রির জন্যই অর্ডার করেছি। কিন্তু যার মধ্যস্থতায় অর্ডার করেছি সেই শাহীনের সঙ্গে আমার কিছু ব্যাবসায়িক লেনদেন আছে। তার কাছে আমি টাকা পাই। তাই হান্নান মিয়ার টাকার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। ‘
হান্নান মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগপত্র ও তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ১৭ তারিখ ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন নিজে স্বাক্ষর করে ৯টি এসি বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু একই দিন ঢাকা থেকে পাঠানো এবং ১৮ তারিখ রাঙামাটি পৌঁছা বাকি ১১টি এসি নিজে নিয়ে নিলেও তাঁর রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করেননি। আবার এসি গ্রহণকারী হিসেবে ‘মাওরুম ট্রেডার্স’-এর নাম এবং ঠিকানা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ আছে! এই উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকানা দেখেই অর্ডারকারীদের বিশ্বাস করেছিলেন হান্নান মিয়া।
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা বলেন, ‘আমরা কোনো এসির অর্ডার করিনি। এই রকম কোনো অর্ডারের বিষয়ও আমার জানা নেই। কেউ যদি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকানা ব্যবহার করে এ কাজ করে থাকে তবে সেটা দুঃখজনক। আমি বিষয়টির খোঁজ নিচ্ছি। ‘
ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন বলেন, আমি সোনার বাংলা হোটেলে এসি সরবরাহের কাজ নিয়ে মহসিনকে অর্ডার করেছি। সে কোথা থেকে কার কাছ থেকে এসি এনেছে আমি জানি না। আমি মালামাল পেয়েছি, বুঝে নিয়েছি। মহসিনকে আমি টাকা দিয়েছি, বাকি কিছুই আমার জানা নেই। ‘
‘জোর করে এসি নামিয়ে রেখে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ’ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার মাল আমি নামিয়ে নিয়েছি স্বাভাবিকভাবেই, জোর করব কেন। ‘ এসির প্রথম চালানের রিসিভে স্বাক্ষর করলেও পরের ১১টির রিসিভে স্বাক্ষর না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইফতারির কারণে আমি ব্যস্ত ছিলাম, তাই স্বাক্ষর করার বিষয়টি মনে ছিল না। ‘
হান্নান মিয়াকে তিনি চেনেন না জানালেও প্রথম দফার এসি রিসিভ করার কাগজে হান্নান মিয়ার স্বাক্ষরের ঠিক পাশেই স্বাক্ষর করেছেন জেলা ছাত্রলীগের এই আলোচিত সভাপতি। হান্নান মিয়া বুধবার তাঁর সঙ্গে দেখা করলে ‘শাহীন কিংবা হান্নান’-কে চেনেন না বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতোয়ালি থানার ওসি কবির আহমেদ বলেন, ‘একটা লিখিত অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। এসি কোথায় রাখা আছে সেটিও আমরা জেনেছি। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। ‘
শাহীন হায়দার নামের ঢাকার ওই ব্যবসায়ী বলছেন, ‘কিছুদিন আগে ধানমণ্ডিতে উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমার জন্য একটি ফ্ল্যাট কেনার বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে মহসিনের পরিচয় হয়। সে আমাকে এসির বিষয়টি জানালে আমি বিক্রয় ডট কমের মাধ্যমে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই।
প্রাথমিকভাবে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা প্রদান এবং রাঙামাটিতে নিয়ে যাওয়ার গাড়ি ভাড়াও দেয় মহসিন। বাকি টাকা মালামাল রাঙামাটি গেলে বুঝে নিয়ে নগদে দেওয়ার কথা। কিন্তু মালামাল রাঙামাটি যাওয়ার পর মহসিন দীর্ঘ সময় ধরে তাদের গাড়িসহ সেখানে বসিয়ে রাখে এবং আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে জানায় যে সে টাকা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে।
পরে ছাত্রলীগ সভাপতি সুজন টাকা না দিয়ে জোর করে মাল নামিয়ে রাখে। বিষয়টি খুবই আপত্তিকর এবং দুঃখজনক। আমি এই বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ”মহসিনের সঙ্গে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন নেই’ দাবি করে এই ব্যবসায়ী তার সঙ্গে মহসিনের কথোপকথনের বেশ কিছু স্ক্রিনশট পাঠান। তিনি দাবি করেন, এসির অর্ডার দিয়ে মহসিন এবং সুজন এখন প্রতারণা করছে। ‘
এদিকে টাকা না পেয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার সারা দিন-রাত রাঙামাটির বিভিন্ন প্রশাসন ও ব্যক্তির দ্বারে দ্বারে ঘোরা এসি ব্যবসায়ী হান্নান মিয়া বলেন, ‘আমি ছোট ব্যবসায়ী। এই টাকা না পেলে আমি মরে যাব। আমি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকানা দেখে তাঁদের বিশ্বাস করেছিলাম, এখন তাঁরা আমাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে।
আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ‘ এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি। ওই লোক আমাকে জানানোর পর আমি তাঁকে পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়েছি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারেই দেখব। ‘