অপরাধএক্সক্লুসিভবাংলাদেশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরাজধানী

প্রেমের জালে ফেলে শারীরিক সম্পর্ক, গোপন ছবি ও ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং

ফেসবুকে সাজ্জাত হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয় মোনালিসা ইসলামের (ছদ্মনাম)। দু’জনের বয়স ২৬ এর ঘরে। দু’জন দু’টি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন। সাজ্জাত দেখতে হ্যান্ডসাম, চালাক-চতুর। কথা বলেন সুন্দর করে গুছিয়ে। মেয়ে পটানোর দক্ষতা তার বেশ। চাকরির বাইরে যেটুকু সময় পান সেটি ব্যয় করতেন ফেসবুকে মেয়ে পটানোর কাজে। 

তার ব্ল্যাকমেইলের সর্বশেষ তালিকায় ছিলেন মোনালিসা। তবে রেহাই মেলেনি। মোনালিসার অভিযোগের ভিত্তিতে  সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম সাজ্জাতকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে তার দেয়া তথ্যমতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ইতি খানমকে (২৪)। তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে।

মোনালিসা বলেন, আমি কখনো বুঝিনি আমার সঙ্গে এমন করবে। ফেসবুকে পরিচয় হলেও খুব অল্প সময়ে আমাকে আপন করে নেয়। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে প্রেমের জালে ফেলে। সবসময় আমাকে খুশি রাখতো। অবিবাহিত ও বড় চাকরি করে বলে পরিচয় দিয়েছিল। মেসেঞ্জারে নিয়মিত কথা হতো। অনেকবার দেখাও করেছি। সেই সুযোগে আমার কিছু ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করে নেয়।

যেসব মেয়ের সঙ্গে সাজ্জাত পরিচিত হয়ে কথা বলেন তাদের অধিকাংশই তার প্রেমে পড়ে। এজন্য তিনি নানা কৌশল প্রয়োগ করেন। তবে মেয়ে পটিয়ে প্রেম করাই তার মূল উদ্দেশ্য না। মেয়েদেরকে পটিয়ে তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটানো উদ্দেশ্য। এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০টি মেয়ের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন প্রেমের সম্পর্ক। সংগ্রহ করেছেন এসব মেয়েদের সঙ্গে কাটানো একান্ত মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও। এগুলো দিয়ে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে দিনের পর দিন করেছেন একের পর এক তরুণীদের সর্বনাশ।

ভুক্তভোগী মোনালিসা আরও বলেন, যখন জানতে পারলাম সে বিবাহিত। তখন সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। ব্যক্তিগত কিছু ছবি আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে আমাকে হুমকি দেয়। সম্পর্ক না রাখলে ছবি ছড়িয়ে দেবে ফেসবুকে। ভাইরাল করে দেবে। ভালো ঘরের মেয়ে আমি।

সামাজিক মর্যাদা ও পরিবারের কথা চিন্তা করে সম্পর্ক চালিয়ে যাই। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। ওই ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। আমাকে তার শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করে। ওই সময় কৌশলে সে আমার আরও গোপন ছবি ও ভিডিও ধারণ করে নেয়। আমি টেরই পাইনি কীভাবে করেছে। আর এসব ছবি ও ভিডিও দিয়ে দিনের পর দিন আমার সর্বনাশ করেছে। আমার সঙ্গে বিগত দিনগুলোতে ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে। যা আমার পুরো জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে।

পল্লবী থানায় করা মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী তরুণী উল্লেখ করেছেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের পরিচয় হয়। পরে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে সাজ্জাত বিভিন্ন সময়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তার অজান্তে মোবাইলে ধারণ করে নেয়।

চলতি বছরের ৭ই ফেব্রুয়ারি সাজ্জাত আমাকে ফোন দিয়ে মিরপুরের একটি স্থানে দেখা করতে বলে। গিয়ে দেখি সে আঘাত পেয়েছে। আমি তার আঘাতের বিষয়ে জানতে চাইলে বলে ইতি খানম (২৪) তাকে জোর করে ৩/৪ জন লোক দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করে মারধর করে ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে।

কিছুদিন পর ইতি খানম আমাকে ফোন করে জানায় সাজ্জাতের মোবাইলে আমার ও সাজ্জাতের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও আছে। অকথ্য ভাষায় আমাকে বকাবকি করে ওইসব ছবি ও ভিডিও যেকোনো সময় ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। কয়েকদিন পর আমার মেসেঞ্জারে সাজ্জাতের আইডি থেকে অন্তরঙ্গ ছবি পাঠায়।

সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ইতি খানমের সঙ্গে সাজ্জাত প্রেমের সম্পর্ক করে তাকেও ব্ল্যাকমেইল করেছিল। কিন্তু ইতি মারধর করে প্রভাব খাটিয়ে সাজ্জাতকে ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করে। বিয়ের পর সাজ্জাতের মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। ওই মোবাইলে অনেক নারীর অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও ছিল।

মোনালিসা বলেন, সম্পর্কের ৬ মাস পরে জানতে পারি সাজ্জাত বিবাহিত ও তার একটি পুত্রসন্তান রয়েছে। বিয়ের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে জানায়, তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যে তাকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে অপারগতা জানালে আমাকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করে।

ইতি ও সাজ্জাতের দ্বিতীয় স্ত্রী মিলে একটি ফেসবুক আইডি তৈরি করে ওই ছবি ও ভিডিওগুলো ভুক্তভোগীর আত্মীয়-স্বজনসহ ঘনিষ্ঠজনদের পাঠিয়ে দেয়। ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভুক্তভোগী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরে সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। যদিও তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে সুস্থ করা হয়।

সাজ্জাতের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তার প্রথম স্ত্রী ও দ্বিতীয় ইতি খানমের বাড়িও বরিশালে। মূলত তারা দু’জন মিলেই সাজ্জাত ও ভুক্তভোগী তরুণীর জীবন অতিষ্ঠ করে  তোলে। সাজ্জাত ও ইতি দু’জন আদালতে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

সিআইডি জানায়, ব্ল্যাকমেইল করে ভুক্তভোগীকে রাজি করিয়ে তার সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছে সাজ্জাত। তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। যেটি সে কাউকে ঠিকমতো বলতে পারছিল না। পরে এক ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে প্রথম অভিযোগ করেন পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই)। সেখান থেকে সাজ্জাতকে ডেকে নেয়া হয়।

কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও তার মোবাইলে কোনো ছবি বা ভিডিও পাননি। অভিযোগ পেয়ে আমরাও তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু তার কাছে কিছু পাইনি। পরে বিষদ জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে আমাদেরকে বলে তার মোবাইল ফোন ইতি খানমের কাছে রয়েছে।

ইতি ভুক্তভোগীর নামে ফেইক আইডি খুলে তার ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে এসব ছবি ও ভিডিও ছড়াচ্ছে। এই তথ্য পাওয়ার পর ইতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় সাজ্জাতের মোবাইল ফোন। পাওয়া যায় ভুক্তভোগী ও সাজ্জাতের অন্তরঙ্গ ছবি। এগুলোর ভয় দেখিয়ে সাজ্জাত ভুক্তভোগীকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে।

সিআইডি’র সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্টের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পর্ক নিয়মিত ও তার শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করে সাজ্জাত। ভুক্তভোগী রাজি হলে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের আরও কিছু ভিডিও ও ছবি সংগ্রহ করে নেয়। যেগুলো দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতো। শুধু ওই ভুক্তভোগী নয়, আরও অনেকের সঙ্গে এ রকম করেছে। মেয়ে পটানোই সাজ্জাতের নেশা। সুন্দর করে কথা বলে যেকোনো মেয়েকে অল্প সময়ে তার আয়ত্তে নিত।

তিনি বলেন, সাইবার স্পেসে না বুঝে অপরিচিত কাউকে বন্ধু তালিকায় নেয়া যাবে না। আর নিলেও তাদের সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা যাবে না। কারণ একসময় এগুলো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

Back to top button