মা-বাবা দু’জনই চাকরিজীবী। সকালে বের হলে ফিরতেন রাতে। দীর্ঘসময় কিশোরীকে বাসায় একাই থাকতে হতো। জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছিল। তাই স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিল না। টেলিভিশন দেখে আর মোবাইল টিপে সময় কাটানো কঠিন ছিল। নতুন এলাকায় বাসা হওয়াতে আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা ছিল না। তাই ওই কিশোরী পাশের ফ্ল্যাটে সময় কাটাতে যেতো।
ওই কিশোরী বলেন, ছোটবেলায় মা-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। যখন বড় হলাম তখন এই বিয়েতে বাধা দিলাম। কারণ যার সঙ্গে পরিবার বিয়ে ঠিক করেছিলেন তাকে আমি পছন্দ করতাম না। কিন্তু আমার পরিবার তাতে রাজি হননি। ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষার পর অবসর সময়ে আমি যখন পাশের ফ্ল্যাটে যেতাম সেখানকার আপুর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আপুর খালাতো ভাই ফাহাদ প্রায়ই সেখানে আসতো। আমাকে প্রথম দেখাতে তার ভালো লেগে যায়। আমার সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য উন্মাতাল হয়ে যায়। প্রথমে সে নিজে আমাকে প্রস্তাব দেয়। আমি রাজি হইনি। কারণ সম্পর্কে যাওয়ার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি। কিন্তু ফাহাদ আর ওই আপুর চাপে আমি সম্পর্ক করতে বাধ্য হই। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের সম্পর্ক। আমার একাকিত্বটা চলে যায়।
বছরখানেক প্রেম করার আগেই তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়। সেই মুহূর্তগুলো গোপনে ধারণ করে রাখতো ফাহাদ। কিছুদিন পর ফাহাদ চলে যায় কানাডা। সেখানে যাওয়ার পর গোপনে ধারণ করা ছবি ও ভিডিও পাঠায় কিশোরীর মোবাইলে।
সেগুলো দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ফাহাদ তার মামা সিফাতের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করে কিশোরীকে। মামার পরে চাচাতো ভাই ও আরেক বন্ধুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে বলে। মেনে নেয়নি কিশোরী। পরে রাগে ও ক্ষোভে ফাহাদ গোপনে ধারণ করা ভিডিও পর্নোগ্রাফি সাইটে ছেড়ে দেয়।
ওই কিশোরী আরও বলেন, ফাহাদকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলি। তার কোনো কথাই ফেলতে পারতাম না। সম্পর্কটা বেশ গভীর ছিল। বছর যেতে না যেতে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেয় ফাহাদ। প্রথমে না করলেও পরে ফাহাদকে খুশি করতে রাজি হয়ে যাই। একদিন তার মামা সিফাতের বাসায় আমাকে নিয়ে যায়। সেখানেই আমাদের প্রথম শারীরিক সম্পর্ক হয়। এরপর প্রায়ই আমাদের মেলামেশা হতো।
ভিডিও পর্নোগ্রাফি সাইটে কিশোরীর, গোপন ভিডিও দেখে পরিচিত অনেকেই তাকে ফোন করে বিষয়টি জানান। উপায়ন্তর না পেয়ে কিশোরী তার পরিবারকে সবকিছু খুলে বলে। পরে ফাহাদ ও তার মামা সিফাতকে আসামি করে পল্লবী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা হয়।
মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। মামলার সূত্র ধরে ডিবি সাইবারের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম অভিযুক্ত মো. সিফাতকে গ্রেপ্তার করে। সিফাত ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোটেল ম্যানেজমেন্ট ও ট্যুরিজমের বিভাগের শিক্ষার্থী। মামলার প্রধান আসামি প্রেমিক ফাহাদ হোসেন কানাডা থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ফাহাদ ও সিফাত সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে।
কিশোরী বলেন, ২০১৮ সালে ফাহাদ স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডা চলে যায়। যাওয়ার আগে আমি আমার পরিবারকে তার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমার পরিবার রাজি হয়নি। আর ওই সময় তার কানাডা যাওয়ার সময় হয়েছিল তাই বিয়ে করাও সম্ভব ছিল না। কথা ছিল দু’বছর পরে এসে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু কানাডা যাওয়ার পর ফাহাদ পুরো বদলে যায়।
হঠাৎ একদিন আমার ইনবক্সে কিছু ছবি ও ভিডিও পাঠায়। যেগুলো দেখে আমি রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যাই। কারণ সেগুলো ছিল ফাহাদের সঙ্গে তার মামার বাসায় কাটানো আমার শারীরিক সম্পর্কের ছবি ও ভিডিও। যেগুলো কৌশলে ধারণ করে রেখেছিল। এগুলো দেখে আমি তার সঙ্গে অনেক ঝগড়াজাটি ও কান্নাকাটি করি।
কেন আমার সঙ্গে এরকম করেছে জানতে চাই। সেদিন আমাকে কোনো সান্ত্বনা দেয়নি। বরং উল্টো আমাকে বকাঝকা করেছে। অথচ আগে আমি কোনো বিষয়ে কান্নাকাটি করলে বিভিন্নভাবে আমার রাগ ভাঙাতো। ওইদিন রাগ না ভাঙিয়ে উল্টো আমার ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের আইডি ও পাসওয়ার্ড চায়। আমি আপত্তি জানালে আমাকে ভয়ভীতি দেখায়।
আইডি-পাসওয়ার্ড না দিলে ছবি-ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবে। এমনকি আমার ঘনিষ্ঠদের কাছে পাঠিয়ে দিবে। প্রথমে আমি তাকে আইডি-পাসওয়ার্ড দেইনি। পরে আমার ছবি দিয়ে ভুয়া আইডি খুলে আমার পরিচিতজনদের রিকুয়েস্ট পাঠায়। তাদের ইনবক্সে ওই গোপন ভিডিও ও ছবি পাঠায়। আমার ঘনিষ্ঠজনরা ফোন করে বিষয়টি আমাকে জানায়। পরে আমি তাকে আমার আসল আইডির পাসওয়ার্ড দেই।
ডিবির ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আশরাফ উল্লাহ বাংলা ম্যাগাজিনকে বলেন, ভুক্তভোগী মামলা করেছিলেন। পরে মূল অভিযুক্ত ফাহাদের মামা সিফাতকে আমরা গ্রেপ্তার করেছিলাম।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। সিফাত বলেছে, ভাগ্নের কথা রাখতেই ওই কিশোরীর সঙ্গে এমনটি করেছে। সিফাতের মোবাইলে অনেক তরুণীর নুড ভিডিও ও ছবি পেয়েছি। অন্তত ৬ জন তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে ভিডিও ধারণ করেছে।
কিশোরী আরও বলেন, ফেসবুকের পাসওয়ার্ড পেয়ে নতুন ফন্দি আটে। আমাকে বলে, সে আমার ভবিষ্যৎ স্বামী। কানাডা থেকে এসে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু বিয়ের আগে তার কিছু চাওয়া আছে। কি চাওয়া আছে জানতে চাইলে সে আমাকে বলে তার মামা সিফাতের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে হবে।
আমি অপারগতা জানালে ফাহাদ আমাকে হুমকি দিয়ে বলে না গেলে আমার সব ছবি-ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। প্রয়োজনে পর্নোগ্রাফি সাইটে দিবে। তার কথামতো চলতে হবে। আমি তাকে কাকুতি মিনতি করে ভাইরাল না করার জন্য বলি। অনেক বুঝিয়েছি তার মামার সঙ্গে এসব করতে পারবো না। তার মন গলাতে পারিনি।
একপর্যায়ে আমি বাধ্য হয়েই তার মামার বাসায় যাই। তার মামা যখন আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করছিল তখন ফাহাদ কানাডা থেকে ভিডিও কলে যুক্ত ছিল। আমার সঙ্গে তার মামা যা করেছে সবকিছু ভিডিও কলে কানাডা থেকে দেখেছে। স্কিন রেকর্ডার দিয়ে সেগুলো সংরক্ষণও করেছে। পরে সেগুলো আমার ইনবক্সে পাঠিয়েছে। এটা নাকি ছিল তার কাছে এক ধরনের ফ্যান্টাসি।
কান্নাজড়িত কন্ঠে কিশোরী বলছিলেন, আমার সহ্য’র সীমা পার হয়ে যায়। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কাউকে বলতেও পারছিলাম। মেনে নিতে পারছিলাম না। এরইমধ্যে ফাহাদ আমাকে বলে মামার পরে তার এক চাচাতো ভাই ও এক বন্ধুর সঙ্গে আমাকে সময় কাটাতে হবে। তার চাওয়াগুলো আর আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। সেজন্য আমি তাকে জানিয়ে দেই তার যা খুশি তাই করার জন্য। পরে জানতে পারি আমার ছবি ও ভিডিও পর্নোগ্রাফি সাইটে আপলোড করে দিয়েছে।